বাংরিপোসি - -
কুমকুম ঘোষ কোলকাতা |
এক রোমাঞ্চকর
অভিজ্ঞতা
কোলাঘাটের শের-ই-পাঞ্জাব এ সকাল ন’টায় লুচি আলুর তরকারি খেয়ে আমরা ছয় বন্ধু রওয়ানা দিয়েছি চেনা রাস্তায়। শ্রাবণ মাসের আকাশে মেঘ-রোদের লুকোচুরি চলছে।দীঘার রাস্তাকে
বামদিকে রেখে সোজা এগিয়ে যাচ্ছি খড়গপুরের দিকে । শহরকে পাশ কাটিয়ে সোজা যাবো বাংরিপোসি-জেলা ময়ুরভঞ্জ- উড়িষ্যা । বাংরিপোসি যাওয়ার দুটো রাস্তা
আছে একটা
ঝাড়গ্রাম ও লোধাশুলি জঙ্গল পেরিয়ে বাহাড়্গোরা হয়ে আর একটা গোপীবল্লভপুর বারিপদা হয়ে
। আমরা প্রথমটা
ধরেছ। কিন্তু এই রাস্তা
খুব ই খারাপ । চিচিরা চেকপোস্টের
পর সেটা আর রাস্তানয়। চাঁদের পিঠে
যেসব বড় বড় গর্ত দেখা
যায় রাস্তার
রূপ ঠিক তেমনটি। দুর্গা নাম জপতে
জপতে সেই তিরিশ চল্লিশ কিলোমিটার পথ পার হওয়া যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি রোমাঞ্চকর ।
বাংরিপোসি নামটার সাথে পরিচয় প্রথম করিয়েছেন বুদ্ধদেব গুহ…পাহাড় জঙ্গল মাদল আর তার কোলে নিজ বাসভূমিতে আদিবাসী মানুষজন - এদের নিয়ে তিনি লিখেছেন অনবদ্য সব জনপ্রিয় উপন্যাস। কলকাতা থেকে বুক করার সময় শুনে এসেছি লেখক
ঠাকুরান পাহাড়ের কোলে বাংরিপোসি গ্রাম |
এখানেই থাকতেন । টিনের চালের
সাধারন বাড়িটি হাইওয়ের একদম
পাশে কিন্তু উন্মুক্ত
প্রকৃতির মাঝে।
২৩০ কিলোমিটার
রাস্তা পেরিয়েছি
প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায় । কিন্তু
প্রথম দর্শনেই অনাবিল প্রকৃতি ভুলিয়ে দিলো
পথের ক্লান্তি । মেঘলা আকাশের কোলে ঠাকুরান পাহাড়ের মাথাটা দেখা যাচ্ছে
। একটু ফ্রেশ হোয়ে দুপুরের খাওয়া সেরেই গেলাম ২০ কিলোমিটার দূরে বিশই হাট দেখতে। স্থানীয় আদিবাসীরা এখানে কেনাকাটা করেন । এই হাটটি একমাত্র শনিবার ই বসে । সেখানে তখন রথ সাজানো হচ্ছে। একটু পরেই তাতে টান পড়বে। সেদিনটা ১৮ ই জুলাই সকালেই স্বয়ং জগন্নাথ পুরীতে তাঁর মাসীর বাড়ী চলে গেছেন । সেই উপলক্ষে সারা উড়িষ্যা সেদিন উৎসবমুখর । হাটটি ঘুরে দেখলাম । বৃষ্টি শুরু হয়েছে তাই আমরাও কিনলাম একটা বড়ো রঙিন ছাতা ১০০
টাকায় । কোলকাতার মতো
একি দাম ! ফিরতি
পথে দেখে নিলাম দুয়ারসিনি দেবীর
মন্দির…ছোট্ট মন্দিরটি পাহাড়ের একপাশে অবস্থিত এবং নিত্য পূজিত। বাংরিপোসির এই পাহাড়ি পথটিতে একটি হাতি যাতায়াতের করিডর আছে। এটি সিমলিপাল অভয়ারণ্যের মধ্যেই পরে। টিপটিপ বৃষ্টি… ভিজতে ভিজতে পথের ধারে চায়ের দোকানে ক্ষণিক থামা আর গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে তাকিয়ে দেখা পাহাড়ের মাথায় ঘন কালো মেঘ আটকে আছে শিবের জটার মত…এ এক রোমাঞ্চকর দৃশ্য যা সারাজীবন মনে থাকবে ফ্রিজ শট হয়ে ।
মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙল পরদিন ১৯শে জুলাই । সেদিন আকাশ অনেকটাই পরিষ্কার । সকালেই বেড়িয়ে পড়লাম ডোকরা গ্রাম কুলিয়ানের উদ্দেশ্যে। ১৯ কিলোমিটার দূরে বিখ্যাত এই গ্রামে শিল্পীদের বাড়ীটাই তাদের
ওয়ার্কশপ । পরিচয় করলাম
শিল্পী যুধিষ্টির রানার সাথে । কিভাবে ডোকরা মূর্তি তারা বানান
সেটা
করে দেখালেন। দুটি ছোট গনেশ
মূর্তি কিনলাম। ফেরার পথে
থামলাম বাংরিপোসি রেলস্টেশনের কাছে বা বলা ভালো উদার
প্রকৃতি থামতে বাধ্য করলো । সবুজ
ধানক্ষেতে বাউল বাতাস সুর ধরেছে উদাস সুরে যেন । দূরে কালচে পাহাড়ের সারি । একপাশে
নিঃসঙ্গ রেললাইন । কিছুটা সময়
কাটিয়ে চলে গেলাম বুড়ি বালাম নদীর তীরে ... এই
সেই নদী যার সাথে বিপ্লবী বাঘা যতিনের নাম জড়িয়ে আছে । পাহাড় নদী আর বিস্তীর্ণ
সবুজ ধানক্ষেত নীরব চিত্রপটের মত স্থির ও মোহময়ী । অজস্র ছবি যেমন ক্যামেরায়
তুললাম তেমনি কিছু চিরকালের জন্য বন্দী করলাম মন ক্যামেরার অন্দরে । শহুরে জীবনকে
প্রকৃতির সান্নিধ্যে অনুভব করে বেশ কিছুটা সময় কেটে গেলো নিমেষে ।
বাজার অঞ্চলটি জনবহুল। বিকেলে এখানেও একটি বড় রথ টান হোল। প্রচুর স্থানীয় মানুষ এতে যোগদান করেন। আমরাও সেই উৎসবমুখর বাংরিপোসির শরিক হলাম ।আরো একবার অনুভব করলাম যুগ যুগ
ধরে মানুষের সাথে
মানুষের মিলন হয় এই উৎসব গুলির মধ্যে দিয়েই । জনগণের হাতের টানেই জগন্নাথের রথ
এগিয়ে চলে মহাকালের দিকে ।
দুদিন কেটে গেলো। ফিরতি পথে আমরা দেখব পঞ্চলিঙ্গেশ্বর। বালাশোর হয়ে যেতে হবে সেখানে ।
গাড়ি ছুটল সেদিকেই ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন