সুধাংশু চক্রবর্ত্তী
হালিশহর, উত্তর ২৪ পরগণা
আপদ
এবছর
প্রচন্ড শীত পড়েছে । সেইসাথে ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে গোটা শহর
জুড়ে । দত্ত বাড়ির নব্বি পেরোনো আনন্দিদিদা এমনিতেই এঁকেবেঁকে এতটুকু হয়ে গিয়ে
যৌবনের সেই দশাসই চেহারাটা কবেই হারিয়ে বসেছেন । এই ঠান্ডায় আরও খানিকটা খাটো
হয়েছেন বহরে । তেমন প্রয়োজন না হলে বেরোতে যান না ঘর থেকে । তেম্ন প্রয়োজন অর্থাৎ
প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে হয় বলেই দিনে বার কয়েক ঘর থেকে বেরতে বাধ্য হন । তাকে
তখন দেখলে মনে হয় যেন নধর একটি কচ্ছপ গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছেন বাথরুমের দিকে ।
বাথরুমে যাওয়া আসার অত চাপ এখন আর নিতে
পারেন না বলে ছেলে বিমানবিহারি কে
বলেছিলেন কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে যাতে ঘরে বসেই কাজটা সাড়তে পারেন । কিন্তু
এখনও অনুমতি আদায় করতে পারেননি । অগত্যা নিরুপায় হয়েই শীতে কুঁকড়ে কচ্ছপ হয়ে
যাচ্ছেন বাথরুমে যাওয়া আসার পথে ।
খানিক
আগেই ছোট কাজের তাড়নায় বাথরুমের দিকে এগোচ্ছিলেন গুটি গুটি পায়ে । ঘর থেকে বেরোতেই
পড়ে গেলেন কণকণে ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়ার কবলে । অমনি গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে গেল ।
তিনিও অমনি কচ্ছেপ থেকেহ্যে গেলেন শত্রুর সামনে পড়ে যাওয়া একটি শজারু ।
আনন্দিদিদার চেয়ে মত্র বছর পঁচাত্তরের ছোট নাতনি দীয়া পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে
দিদাকে ঐ অবস্থায় দেখে হেসে কুটিপাটি হলো ।
আনন্দিদিদা
রেগে গিয়ে কিছু একটা বললেন নাতনীকে, যার একবর্ণও বোঝা গেল না । বোঝা যাবে কি করে
?একে তো শীতে কাঁপছে ঠক ঠক করে । তার উপর কথা বলত গেলেই নাক আর চিবুকের মধ্যে লেগে
যাচ্ছে বেজায় ঠোকাঠুকি । এত কিছু চাপের মধ্যে পড়ে কথাগুলো তো গুড়িয়ে যাবেই । তবে
দীয়ার কোন অসুবিধা হলো না বুঝতে । তাই হাসি চাপতে চাপ্তেই বলে বসলো, বুড়ীর
দেখছি খুব শখ হয়েছে জল ঘাটতে । এত ঠান্ডাও
বুঝি ঘরে আটকে রাখতে পারলো না তোমাকে ?
আনন্দিদিদা
আর কথা না বাড়িয়ে রাগে গট মট করতে করতে
হাঁটা দিলেন বাথরুমের দিকে । দীয়ার নিজেরও এই ঠান্ডা একদম পছন্দ হচ্ছে না ।
সে কারণেই পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল হাঁটাহাঁটি করে গা গরম করবে বলে । তাতে কতটা
কি লাভ হলো বলতে পারবে না । তবে বেশ খানিকটা বকুনি জুটে গেল মায়ের কাছ থেকে ,
পড়াশোনা মাথায় তুলে দিয়ে সেই থেকে এ ঘর সে ঘর ক্রছিস কেন ? স্কুলের পড়াগুলো কে
করবে শুনি ? যাও, বইখাতা নিয়ে বসো । আর যেন না দেখি ঘোরাঘুরি করতে ।
দীয়া
বকাটকা খেয়ে আবার ফিরে এলো পড়ার ঘরে । ঘরটা বাড়ির উত্তর দিকে । বিশাল দুটো জানলা
রয়েছে এই ঘরে । দুটোতেই কাঁচের পাল্লা । সেই জন্য ঘরটা বেজায় ঠান্ডা হয়ে রয়েছে ।
বিখাতা খুলে বসলে হবে কি, কিছুতেই মন বসাতে পারছে না দীয়া । পাতা ওলটাতে গেলেও তো
হাত বের করতে হবে চাদরের ভেতর থেকে । অথচ এবারের শীতে মুখটুকু ছাড়া আর কিছুই বের
করে রাখা যাচ্ছে না । তবু কিছুটা সময় বসে থাকল বইখাতা খুলে ।
খানিক
পরই এক ঝলক রোদ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল জানলার কাঁচের উপর । সেই দেখে দীয়া ঠিক করলো
বইখাতা নিয়ে ছাদে গিয়ে পড়াশোনা করবে রোদে বসে । সেই ভেবেই মায়ের কাছে অনুমতি আদায়
করতে ছুটলো, ওমা, ছাদে গিয়ে পড়াশোনা করবো ? ওখানে বেশ রোদ উঠেছে দেখলাম ।
-
যাও, তবে শুধু লেখাপড়াই করবে । এদিক
ওদিক তাকিয়ে সময় নষ্ট করবে না যেন ।
মা
নিজেও বেজায় কাবু হয়ে আছেন এই শীতে। তাই মেয়ের কষ্ট বুঝতে কষ্ট হলো না তার । পারলে
তিনিও গিয়ে বসেন রোদ্দুরে । কিন্তু সুখের কাঁথায় যে আগুন । সবে সকাল দশটা বেজেছে ।
এখনও অনেক কাজ পড়ে রয়েছে রান্নাঘরে ।
দীয়া
ছাদে উঠে এসে রোদে মাদুর পাততে পাততে স্বগোতোক্তি করলো, উফ্ যা ঠান্ডা পড়েছে!
গোটা বাড়িটাই ছাদে তুলে নিয়ে আসলে ভালো হয় ।
কিছুক্ষণের
মধ্যেই নারকেল গাছের ছায়াটা ঝ্প করে এসে জুড়ে বসলো দীয়ার ওপর। দীয়া পাশে পড়ে থাকা
একটুকরো রোদের দিকে সরে বসেই স্মান্য গলা চড়িয়ে বললো, আ-প-দ । হয়তো ঈশ্বরের
উদ্দেশ্যেই উগড়ে দিলো নিজের মনের ক্ষোভ।
ঈশ্বর
শুনে হাসলেন । আধ ঘণ্টাও হলো না এসে বসেছে রোদে, তার মধ্যেই গোটা আকাশটা ঢেকে গেল
ঘন মেঘের চাদরে । সেই সাথে শুরু হল ঠান্ডা বাতাসের প্রচন্ড দাপাদাপি । দীয়া
দুর্দাড়িয়ে নেমে এলো মাদুরটা বগলদাবা করে । ওকে ওভাবে নামতে দেখে মা অবাক চোখে
তাকাতেই দীয়া আবার সেই একই কথা উগড়ে দিলো, আ-প-দ। কার উদ্দেশ্যে কে জানে ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন