প্রথম বর্ষ, শারদ সংখ্যা, ১২ অক্টোবর' ২০১৫

সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৫

বড় গল্প

                                                                                   বাপি ভট্টাচার্য
                                                                                                                                 কোলকাতাঅবলম্বন
এক
সায়ন্তন নিজের প্রাইভেট গাড়ীটা নিয়ে অবলম্বন”-এর সামনে এসে নামে তখন ঘড়িতে ঠিক সকাল ৭ টা ১০অবলম্বন”-- একটি বৃদ্ধাশ্রম। খুব একটা বড়  নয়, দুতলা বাড়ি, এক তলায় ১২টি, দুতলায় বারোটি। মোট ২৪টি ঘর। ২২টা ঘরে আবাসিক থাকে, একটা ঘরে অফিস, আর একটা ঘরে ঠাকুর চাকররা, হ্যাঁ, আর একটা ঘর আছে সেটা রান্না ঘরের পিছন দিকে, ভাঁড়ার ঘর। এখন সাকুল্যে ২০ জন আবাসিক। সায়ন্তনকে নিয়ে হলো ২১এখনও এক জন থাকতে পারে।  আপাতত সেটি খালি আছে।
সায়ন্তন দাসবয়স বেশী নয়, মাত্র ৬৬ বছর। সে ছিলো কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। প্রচুর টাকা ইনকাম ছিলো। এছাড়াও  পৈতৃক অগাধ সম্পত্তির মালিক। তা নয় নয় করে সব মিলিয়ে সারে ১৮ কোটি টাকার মালিক। সে বিয়ে করেনি। তার নিজের এক দূর সম্পর্কের ভাইপো ছারা কেউ নেই। শেষ জীবনটা সে ভাইপোদের সাথে থাকতে চায় নি, কারণ তারা তার পয়সাকে ভালোবাসে, তাকে নয়। তাই সে ঠিক করে সে বৃদ্ধাশ্রমে থাকবে, তার মতো যারা, যাদের কেউ নেই, তাদের মাঝে, তাই ভাইপোকে তার পৈতৃক বাড়িটা আর কিছু টাকা দিয়ে সে এই অবলম্বনবৃদ্ধাশ্রমে এসে থাকবে ঠিক করে। সায়ন্তন যে রকমটা চেয়েছিল, ঠিক সেই রকম এই অবলম্বন বৃদ্ধাশ্রম।    
সায়ন্তন গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকে। সায়ন্তনকে দেখে কয়েক জন আবাসিক গাছের পরিচর্যা করছিলেন, তারা উৎসুক হয়ে এগিয়ে আসেন। কেয়ারটেকার কাম বাজার সরকার কাম পরিচারক হরিচরণ দৌড়ে আসে।  
-- আসুন, বাবু আসুন। আপনার জন্য দিদিমণি অপেক্ষা করছে। --- বোলতে বোলতেই নির্মলা দেবী ভেতর থেকে এসে পড়েন। 
-- নমস্কার, মিস্টার দাস, আসুন। আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। চলুন ভেতরে, আপনারাও আসুন, ওনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো।  
-- নির্মলা দেবী, কাউকে দিয়ে পিছনের গাড়ীর জিনিস গুলো নামিয়ে নিন। আপনার সাথে যা কথা হয়েছিলো সে গুলোই আছে।
সায়ন্তন নির্মলা দেবীকে বলেছিলেন, যে তিনি এই অবলম্বনেপ্রত্যেক ঘরের জন্য একটি করে টিভি, আর অফিসের জন্য একটি, মোট ১৩টি টিভি-, ২টি ফ্রিজ, ৩টি মেশিন আর এ,সি মেশিন দেবেন, সেই গুলোই নিয়ে এসেছে। শুধু এ-সি মেশিন গুলো আসেনি, সেগুলো কাল আসবে। এই বৃদ্ধ মানুষ গুলোকে একটু ভালো রাখার জন্য এই সব। ক দিনই বা বাঁচবে এই বৃদ্ধ বৃদ্ধারা? নিজের কাছের লোকের থেকে, সংসার থেকে বিতাড়িত, এক ঘরেএকাকী থাকার জ্বালা থেকে, একটু ভালো রাখার চেষ্টা করেছে।
নির্মলা দেবী হরিকে বলেন-হরি, তাড়াতাড়ি যা, ওই গাড়ীতে যা যা আছে সব ভেতরের ঘরে নিয়ে রাখার ব্যবস্থা কর। 
--হ্যাঁ, এইতো, এখুনি যাচ্ছি, দিদিমণি।
সবাই মিলে অফিসের বসার ঘরে এসে বসে। নির্মলা দেবী রান্নার ঠাকুরকে চা করতে বলে, সায়ন্তনকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সায়ন্তন সবার সাথেই নমস্কার বিনিময় করে। হরি, গাড়ীর লোকদের দিয়ে এক এক করে সব নিয়ে ভেতরে ঢোকায়। সবাই অবাক হয়ে যায়, টিভি, ফ্রিজ গুলো দেখে। সায়ন্তন হরিকে বলে
-- হরি, আমার ঘরটা দেখিয়ে দাও, আমি একটু মুখ হাত ধুয়ে আসি। তারপর তোমাকে নিয়ে একটু বাজারে যাবো।   
-- আপনি দোতলার সামনের দিকের প্রথম ঘরটায় যান, ওটাই আপনার জন্য ঠিক করেছি। --নির্মলা দেবী বলেন।
–- আমি একটু আসছি, এসে এক সাথে চা খাবো।
 সায়ন্তন সবাইকে বলে, দোতলায় উঠে যায়, নিজের ঘরটায় ঢুকে, একবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে নেয়। মনে মনে ভাবে, ঠিকই আছে সব, বাথরুমে ঢুকে যায়, একটু পরেই বেড়িয়ে আসে, আর তখনই টেবিলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পরে, টেবিলে ওপর রাখা ফুলদানিটাতে অনেক গুলো লাল গোলাপ রাখাসে গুলো দেখে তার স্বর্ণলতারকথা মনে পরে যায়। স্বর্ণলতাগোলাপ খুব ভালবাসতো, ওর জন্য সে রোজ গোলাপ নিয়ে যেতো, আর স্বর্ণলতা কি খুশিই না হতো। ওর সারা মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠত। আর সে স্বর্ণর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখত ওর খুশি। আজ কেমন আছে তার স্বর্ণ"? আগামী পরশু তার স্বর্ণ"র জন্ম দিন। এই দিনটা সায়ন্তন  একা একাই তার ভালবাসার জন্ম দিন পালন করে এসেছে। এবার সেটাই এদের সাথে করার ইচ্ছা আছে। সায়ন্তন একবার ফুল গুলো তুলে ঘ্রাণ নেয়, তারপর একটা চুমু খেয়ে  আবার রেখে দেয়। নিচে নেমে আসে। নিচে নেমে দেখে সবাই বসে আছে তার জন্য, সায়ন্তন হরিকে বলে
-- দে হরি, চা দে,  
-- আমি দিচ্ছি বাবু,--ঠাকুর বলে
-- তুমি দেবে, দাও, তাহলে হরি, তুই এক কাজ কর, টা বাজারের থলি নিয়ে আয়, আজ আমার তরফ থেকে তোমাদের লাঞ্চ আর ডিনার  খাওয়াবো  সবাইকে।  সবাই আমিষ খান তো
-- হ্যাঁ, সবাই আমিষ খায়কিন্তু, আপনি কেনো খরচ করবেন, দাদা? এটা তোনির্মলার কথা শেষ হবার আগেই সায়ন্তন ওকে থামিয়ে দেয়।    
-- দাদা বললে, তারপরেও প্রশ্ন কেনো? আমি আগেই বলেছিলাম যে আমি যা করবো, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না। তাহলে?
-- না মানে, দাদা
-- না আর কিন্তু নয়, এবার তুই থাম, আজ থেকে তুই আমার বোন, আর আমি তোর দাদা। আর আপনাদের মধ্যে কেউ যদি আমার থেকে বড় থাকেন তাহলে তাকে আমি দাদা বলবো, আর আপনারা আমাকে শুধু অয়নবলে ডাকবেন, প্লিজ। আমার ডাক নাম অয়ন”  
-- বেশ তাই হবে, তবে আমরা তোমার থেকে বড় নয়, সমবয়সী হব, না হলে দুএক বছরের ছোটো।   
-- নির্মলা, আর একটা কথা, এখানকার কেবল টিভির অফিসটা কোথায়? বাজারে যাবার সময় বলে যেতাম, আজই যেন কানেকশানটা করে দেয়।
হরি ভেতর থেকে দৌড়ে গিয়ে কয়েকটা বাজারের থলে নিয়ে এসে সায়নকে বলেচলুন বাবু, আমি চিনিয়ে দেবো। 
-- তুই চিনিস! তাহলে চল,-- বাজার থেকে এসে টিফিন খাবো, ঠাকুর। 
-- ঠিক আছে বাবু, আপনি আসুন।
সায়ন্তন হরিকে নিয়ে বাজারে চলে যায়।        
দুই
ঘণ্টা দেড়েক পরে সায়ন্তন বাজার থেকে ফেরে। মাছ-মাংস, শাক-সবজি নিয়ে আসে। নিজের ঘরে গিয়ে জামা কাপড় পালটিয়ে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পড়ে নিচে নামে। ঠাকুর সবাইকে খাবার টেবিলে ডাকে, যদিও মহিলাদের আগেই খাওয়া হয়ে গেছিলো, তবুও তারা আসে গল্প করার জন্য। ঠাকুর সবাইকে লুচি, আলুর-দম, পরিবেশন করে। সবাই খেতে খেতে গল্প করতে থাকে। সবাই সায়ন্তনের কাছে জানতে চান, সে কি করতো? এখানে কেনো এলো? তার কে কে আছে? সায়ন্তন, এক এক করে সব বলে ওর কথা। হটাৎ সায়ন্তনের একটা কথা মনে পরে যায়, সে নির্মলাকে বলে
-- নির্মলা, পরশু দিনও আমার তরফ থেকে তোমাদের নিমন্ত্রণ রইল। পরশু দিনটা আমার কাছে একটা বিশেষ দিন, এতো দিন এই দিনটাকে  আমি একা একাই কাটিয়ে আসছি, কাল আমি আপনাদের নিয়ে কাটাবো। প্লিজ, কেউ না করবেন না।
-- আমি থাকবো না -- কান্তি-বাবু বলেন।
-- সে কি! কেনো?
-- দ্যাখো অয়ন, তুমি আমাদের ভাই, বন্ধু যাই ভেবে থাকো, তার জন্য আমরা খুব, খুব খুশি। কিন্তু তার বদলে, তুমি যা বলবে‌ আমাদের শুনতে হবে, আর তুমি আমাদের কথা শুনবে না, তা কি হয়।
-- কিন্তু, আপনাদের কথাটা কি, যে আমি শুনবো না।
-- বেশ, তাহলে বলো, কালকের দিনটা, কেনো তোমার কাছে, একটা বিশেষ দিন? বলো?
-- ও এই ব্যাপার, বেশ বলছি, কাল আমার এক বিশেষ পরিচিতার জন্মদিন। এতদিন আমি একা একাই পালন করে এসেছি। কাল আপনাদের  নিয়ে পালন করবো, ঠিক করেছি।
-- এই বিশেষ পরিচিতা ভদ্র মহিলাটি কে? – ঝুমা দেবী জিঙ্গাসা করেন।
সায়ন্তন একটু লজ্জা পেয়ে যায়, এই ৬৬ বছর বয়সে তাঁর প্রেমের কথা বোলতে হবে তাই। সায়ন্তন একটু অন্য ভাবে কথাটা বলে-
-- ধরে নিন, সে আমার খুব খুব কাছের একজন।
-- কতটা কাছের?
-- সে ইচ্ছে করলে একদিন হয়তো, এই ৬৬ বছরের বুড়োটার স্ত্রী হতে পারতো। 
--সে কি তাই?—সবাই এক সঙ্গে বলে ওঠে,
-- তা হলো না কেনো, দাদা?
-- থাক না আজ, আর একদিন বলবো। আমি তো আর চলে যাচ্ছি না।
-- বেশ তাই বলো, কিন্তু, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে দাদা?—নির্মলা বলে।
-- বল, কী তোর প্রশ্ন,
-- আমার যিনি বৌদি হতে পারতো, তাঁর নামটা কী জানতে পারি?
-- হ্যাঁ, হ্যাঁ, বৌদির নামটা বলুন?
 সবাই জানতে চায়। সায়ন্তন, একটু চুপ থেকে, তারপর বলে
-- “ স্বর্ণলতা”—বিয়ের আগে ছিল স্বর্ণলতা মুখার্জী, আর এখন স্বর্ণলতা চ্যাটার্জী
নামটা শুনে নির্মলা বলে কি নাম বললে দাদা? “স্বর্ণলতা চ্যাটার্জীদাঁরাও আসছি।
বলেই নির্মলা দৌড়ে অফিসে আসে। ওর পিছন পিছন কৌতূহল নিয়ে সবাই অফিসে আসে, সায়ন্তনও আসে।
নির্মলা অফিসে এসে আবাসিকদের ফাইলটা বার করে খুলতেই প্রথমেই, দেখতে পায় সেই নাম। স্বর্ণলতা চ্যাটার্জী” 
-- দাদা, দাদা, দ্যাখো তো ইনি কি না?
-- সায়ন্তন, তাড়াতাড়ি ফাইলটা নিয়ে ছবিটা দেখে, চমকে ওঠে, এই তো তাঁর স্বর্ণ”,
-- হ্যাঁ, এই সে, কিন্তু, এখানে কেনো?
-- উনি পরশু এখানে আসছেন,
-- কী? কেনো?
-- ওনার ছেলে, ছেলের বৌ, এসে কথা বলে গেছেন।  
-- , তাই বুঝি।

অয়ন আর কিছু না বলে, আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠে, নিজের ঘরে চলে যায়। নিজের ঘরে গিয়ে, অয়ন টেবিলের সামনে গিয়ে সোফায় বসে ফুলদানিটার দিকে তাকিয়ে ভাবে, তাঁর স্বর্ণ-র সিঁথির সিঁদুর কবে মুছে গেলো? তাঁর ছেলে তাকে যায়গা দিলো না? এই কি এখন কার প্রজন্মের স্বভাব? বৃদ্ধ মা-বাবাকে পরের অবলম্বনে বেঁচে থাকার জন্য পাঠিয়ে দেয়। স্বর্ণর জন্য একটা চাপা   কষ্ট অনুভব হয়। সে তো এ রকমটা চায় নি। স্বর্ণর ছবিটা দেখে মনে হলো একটু রোগা হয়ে গেছে, দেখতে একই রকম আছে, শুধু মুখের বয়সের ছাপ পষ্ট, চামরা একটু শিথিল হয়েছে। চোখের দৃষ্টি  হয় তো ঝাপসা হয়েছে। চোখে কালো ফ্রেমের চশমাটা মানিয়েছে ভালো। বেশ একটা গুরু গম্ভীর ভাব। সায়ন্তন হেসে ফেলে, স্বর্ণলতার মুখটা মনে করে। কিন্তু স্বর্ণ কোনো দিনও গম্ভীর ছিলো না, কলেজ লাইফে কলেজের মধ্যে সব থেকে প্রাণ চঞ্চল, সব  থেকে ছটফটে ছিল। নিজের অজান্তে মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে। একটা ভাললাগার অনুভূতি অনুভব করে, স্বর্ণ এখানে থাকবে শুনে।   

হটাৎ, জানালা দিয়ে একটা দমকা হাওয়া দিয়ে গোলাপ গুলোকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। তার মনে হোল ফুলদানির গোলাপ গুলোও হাসছে, তাঁর সাথে। সায়ন্তন গোলাপ গুলো নিয়ে বুকের কাছে নিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করে বলে --
-- শুনেছিস? কাল সে আসছে, তোর ভালোবাসার সেই সেসায়ন্তনের মনে হলো গোলাপ গুলো যেন বলে উঠলো-
-- আমি জানতাম তুমিও আসবে, সেও আসবে
-- তাই তুই জানতিস, সে আসবে,
ফুল গুলো আবারও হাওয়ায় দোল খেয়ে হেসে ওঠে।
-- আচ্ছা বলতো? সে আমাকে চিনতে পারবে? কতো দিন পর দেখা, প্রায় ৩৬-৩৭ বছর। হ্যাঁরে, সত্যি সে আসবে তো? যদি না আসে? যদি সে আমাকে আবার চলে যেতে বলে, যদি সে আমার সাথে এইখানে না থাকতে চায়? তা হলে, আমি কি করবো? ওর কথা শুনে, চলে যাবো, না জোর করে থেকে যাবো? কিন্তু জোর করার লোক তো সে নয়, জোর করার হলে সেই ৩৬-৩৭ বছর আগেই করতে পারতাম। সেই শেষ দিনের, শেষ বারের মতো শেষ দেখাস্বর্ণর শেষ কথাটা এখনও তাঁর কানে বাজে, এখনও সে ভোলে নি -- তুমি আর এসো না অয়ন যদি আবার সেই কথাটা বলে? বলতো কী করি?
অয়ন ফুল গুলোকে বুকের কাছে নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে, এই সব ভাবে। কতক্ষণ এই ভাবে ঘোরের মধ্যে ছিলো জানে না, ঘোর কাটে হরির ডাকে
-- বাবু, বাবু--
সায়ন্তনের তন্দ্রা কেটে যায়, তাকিয়ে দেখে, হরি ডাকছে।
-- কিরে হরি?
-- বাবু, আপনি স্নান সেরে নিচে আসুন, রান্না হয়ে গেছে। সবাই আপনার জন্য বসে আছে।
-- অনেক বেলা হয়ে গেছে না রে? তুই যা আমি আসছি।
সায়ন্তন তোয়ালেটা নিয়ে বাথরুমে চলে যায়। মিনিট পনের-কুড়ি পর বেড়িয়ে নিচে নামে। সবাই বসে আছে ওর জন্য। অমল বাবু জিঙ্গাসা করে
-- তখন তুমি স্বর্ণলতার ছবিটা দেখে ওপরে উঠে গেলে, খুব খারাপ লেগেছে।
-- না ঠিক তা নয়, কিছুটা ঠিক। যেমন তার বিধবা হওয়াটা দুখের, তেমনি এখানে আসাটাও একটু খুশির। কারণ কত দিন ছেলে, ছেলে বউয়ের দয়ার যন্ত্রণায় বেঁচে থাকবে। তাঁর থেকে এখানে একটু হলেও শান্তি পাবে। যেমন আপনারা এখানে এসেছেন বা এখানে ছেলে মেয়েরা দিয়ে গেছে, তাতে কি আপনাদের মনে একটু হলেও শান্তি আসে নি? নিত্য সংসারের অশান্তির চেয়ে এইটা একটু ভালো নয়হয়তো, নাতি-নাতনিদের মুখটা মনে পরলে কষ্ট হয়, চোখ দিয়ে জল পরে। আবার এখানের সবার সাথে মিশে দুঃখ গুলো ভুলে যান বা ভুলে থাকেন, তাই না?
-- তুমি ঠিক বলেছ অয়ন, মাঝে মাঝে কষ্ট হয় ঠিক কথা, তবু এই ভালো আছি।  
-- সেই জন্যই বললাম স্বর্ণ এখানে আসছে ভালই, হোল।
-- তুমি,কিন্তু বললে না, স্বর্ণলতার সাথে তোমার বিয়ে হয়নি কেনো? কাল তো তোমার স্বর্ণলতা এসে যাবে তখন কি আমাদের কথা মনে থাকবে?
এই সময়, ঠাকুর এসে বলে আমার রান্না হয়ে গেছে। আপনারা বললেই খেতে দেব।
-- বাহ, তাহলে দাও আমাদের খেতে। খেতে খেতে স্বর্ণর কথা বলবো,
 সবাই খাবার টেবিলে এসে গোল হয়ে বসে, টেবিলটা বেশ বড়ই, একটু চেপে চুপে বসলে সবার হয়ে যায়।
-- কি কি রান্না করেছো ঠাকুর।
-- আজকে, আমাদের গাছের মোচা ঘণ্ট করেছি, চিংড়ি মাছ, আর ইলিশ মাছ। রাত্রে মাংস আর লুচি।
-- আহা, দারুণ, জমবে।
-- আমাকে ইলিশ দিও না ঠাকুর আমাকে চিংড়ি দিও।
-- কেনো অয়ন? ইলিশ খাবে না তুমি?
-- হ্যাঁ, খাবো তো, তবে আজ নয় পরশু
-- কেনো? পরশু কেনো?
-- না মানে, স্বর্ণলতা ইলিশ মাছ খেতে খুব ভালোবাসে, যখন শুনলাম কাল সে আসছে, তাই তাকে ফেলে কি করে খাই? আর তাছাড়া, পরশু ওর জন্ম দিন, একসঙ্গে খাবো। আপনারা খান, আমি পরশুদিনের জন্য আরও বড় বড় মাছের অর্ডার দিয়ে এসেছি। হরিকে জিঙ্গাসা করুন।
-- হ্যাঁ, বাবু আরও মাছের অর্ডার দিয়েছেন।
-- তোমাকে, তোমার ভালবাসাকে শ্রদ্ধা না করে পারছিনা। ধন্য তুমি, ধন্য তোমার ভালবাসা।
-- না না এভাবে বলবেন না, ও যদি না আসতো তাহলে আমি খেতাম। যখন, ও আসছে জানলাম, তখন আর নাই বা খেলাম,
-- বাবু, কালকের কাতলা মাছ আছে খাবেন?
-- বাহ, বেশ তাই দিও। কি? হোল তো এবার?
-- বেশ তাই হোক, তুমি শুরু করো তোমার স্বর্ণর কথা। 
-- হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই ভালো,
-- বেশ, বলছি,
ঠাকুর সবাইকে খাবার দিয়ে যায়, অয়ন শুরু করে স্বর্ণলতার কথা।

তিন

স্বর্ণলতার সাথে আমার প্রথম পরিচয়, আজ থেকে প্রায় ৩৮/৩৯ বছর হবে। ইউনিভার্সিটিতে আমি Physics Honors নিয়ে M.Sc-তে ভর্তি হই। সেই সময়, স্বর্ণলতাও একই সাবজেক্ট নিয়ে ভর্তি হয়। ফলে আমরা ক্লাস মেট ছিলাম। বরাবরই আমি Physics-এ ভালো ছাত্র ছিলাম। সেই সুবাদে ওর সাথে আমার পড়াশুনা নিয়ে, কিম্বা, নোটস দেয়া-নেয়া হতো। আর সেই দেয়া-নেয়ার মাঝে আমরা দুজনে দুজনের কাছাকাছি চলে আসি।
এই পর্যন্ত বলে অয়ন একটু থামে, কিছুটা ভাত খেয়ে, আবার বোলতে শুরু করে।  

স্বর্ণলতা কতবার আমাদের বাড়ি এসেছে, আমার মা স্বর্ণলতাকে খুব ভালবাসত। বাবাও খুব ভালোবাসতেন। আমাদের কাঠের গোলা ছিলো। কাঠ আসতো সুদূর বার্মা থেকে। বাবা,দু-তিন মাস ছারা ছারাই, এক বার করে  বার্মায় যেতেন। আর বাবা সেখান থেকে মার জন্য যেমন  শাড়ি বা গহনা নিয়ে আসতেন, তাঁর সাথে সাথে, স্বর্ণর জন্যও নিয়ে আসতেন। এতটাই ভালবাসতেন বাবা, স্বর্ণকে। আমারও ভালো লাগতো ও কে। ও খুব খোলা মনের মেয়ে ছিল, আর ভীষণ ছটফটে ছিল। ওর এই গুন গুলো আমার ভীষণ ভালো লাগত। আর সেই ভালো লাগা, কখন যে, দুজনে দুজনকে ভালবাসায় পরিণত করে ফেলি, আমরা নিজেরাই বুঝতে পারিনি। আমরা পাশ করে বেরোবার পরে, আমি একটি বহুজাতিক সংস্থায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এর চাকুরীতে ঢুকে যাই। আমাদের রোজ দেখা, কথা বার্তা চলতে থাকে। আমরা কিন্তু দুজনে দুজনকে তোমাকে ভালবাসিকোনো দিন বলিনি। হ্যাঁ, আমরা নিজেদের মধ্যে একটা টান অনুভব করতাম, এ কথা ঠিক, কিন্তু আমরা কেউ কাউকে প্রেম নিবেদন করিনি
-- সে কি
-- সেই কারণেই কি তোমাদের বিয়েটা হোল না? মানে মুখ ফুটে ভালবাসার কথা বলতে পার নি বলেই কি? অভিমানে-- 
-- না ঠিক তা না হতে পারে, কারণ, তাকে আমি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। একদিন, আমি হটাৎ-ই বলি আমায় বিয়ে করবে স্বর্ণআমার এই কথাটা শুনে ও লাফিয়ে উঠেছিল, খুশিতে, ঝলমল করে উঠেছিল। সেদিন অনেক্ষন ছিল আমার সাথে। আমাদের সংসার কেমন হবে? বিয়ের পর কোথায় বেরাতে যাবে? এই সব নিয়ে অনেক পরিকল্পনা করেছিল। তারপর, ঠিক করি পরশুদিন ওর বাবার কাছে আমি যাব আমাদের বিয়ের কথা বলতে। স্বর্ণ তাঁর বাবাকে আগেই বলে রাখবে আমার কথা। 
-- কিন্তু, তুমি কেনো? তোমার বাবা-মা গেলেন না কেনো?
-- স্বর্ণলতা চেয়েছিল, আমি নিজেই গিয়ে ওর বাবা কে বিয়ের কথা বলি।
এই পর্যন্ত বলে অয়ন আবার একটু থামে। তারপর ঠাকুরকে বলে ঠাকুর আর একটা চিংড়ি হবে? খুব ভালো রান্না করেছো।
ঠাকুর হ্যাঁ হবে বলে আরেকটা চিংড়ি মাছ এনে অয়নকে দেয়। অয়ন খুব তৃপ্তি সহকারে খেতে থাকে। ওর খাওয়া দেখে, বিনয় বাবু বলে-
-- তুমি খুব খেতে ভালোবাসো, তাই না অয়ন?
-- আমি যেমন খেতে ভালোবাসি, তেমনি খাওয়াতেও ভালোবাসি। খান, খান। এই বয়সে দুএক দিন বেশী খেলে, এমন কিছু ক্ষতি হবে না। আমি একটা কথায় বিশ্বাস করি, “ যাহা দেবেন অঙ্গে, তাহা যাবে সঙ্গে,”—
-- বাহ, দারুণ বলেছ তো,- “ যাহা দেবেন অঙ্গে, তাহা যাবে সঙ্গে,”— হা- হা হা দাও ঠাকুর আমাকেও আরেক পিস ইলিশ মাছ দাও। 
-- হা- হা হা অয়ন জোরে হেসে ওঠে।
অয়ন আর বিনয়-বাবুর দেখা দেখি অনেকেই আরেক পিস করে মাছ নেয়। সবাই খুব আনন্দের সাথে খেতে থাকে। অমল-বাবু, গম্ভীর গলায় বলেন--          
-- তারপর, তারপর তুমি গেলে স্বর্ণলতার বাড়ি?
-- হ্যাঁ, গেছিলাম সেদিন ওর বাড়ি, বাড়ির দরজার সামনে এসে কলিং-বেল বাজাতে যাবো কি, ভেতর থেকে স্বর্ণলতা আর তার বাবার কথা কাটা কাটি শুনতে পেলাম, কি নিয়ে কথা কাটাকাটি তা শুনতে পাই নি, কিন্তু, দুজনের গলা বেশ উত্তেজিত ছিলো সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। যাই হোক, আমি কলিং-বেল বাজালাম। একটু পরেই স্বর্ণলতা দরজা খুলে সামনে দাঁড়াল, তার চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারি, সে কাঁদছিল। সে আমার সামনে হাত জোর করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। তারপর অনেক কষ্টে, কান্না ভেজা গলায় বলেছিল --- তুমি আর এসো না অয়ন” -- এই পর্যন্ত বলে অয়ন চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকে। সবাই খাওয়া বন্ধ করে বসে থাকে। তারা বুঝতে পারে অয়নের কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে নির্মলা বলে-
-- থাক দাদা আর বলতে হবে না। তোমার কষ্ট হচ্ছে। তুমি খেয়ে নাও।
-- না রে, কষ্টর কিছু হচ্ছে না, আসলে, যখনই স্বর্ণর শেষ কথা গুলো মনে পরে, ওর ওই কান্না ভেজা চোখ আর ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা আমাকে নাড়িয়ে দেয়, সেদিনের ওর ওই মুখটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারিনি। তুমি আর এসো না অয়ন”—এই কথাটা আমার সাথে ওর শেষ কথা। সেদিন থেকে আমি কোনো দিন আর ওর মুখোমুখি হই নি। কোনোদিনও তার সামনে আসি নি।
-- কিন্তু কেনো? কেনো সে এ রকম করলো তুমি জানতে চাও নি?
-- না, সেদিন আমি কোনো কথা জিঙ্গাসা করি নি, কেনো? কি হয়েছে? তার কিছুই আমি জানতে চাইনি। ও ওই কথাটা বলার পরেই আমি চলে আসি। আমি তার চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়েছিলাম। আমি শুধু জানতাম, বা বুঝেছিলাম, সে আমাকেই ভালোবাসে। তার ভালবাসাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলাম, কারণ আমিও যে তাকে ভালবাসি। যাকে ভালবাসি তার যাতে কষ্ট না হয় সেটাই চেয়েছিলাম, এখনও চাই সে সুখে থাকুক। কিন্তু সে তো হবার নয়। সে সুখ পায়নি। সে স্বামী হারা হয়ে, নিজের সন্তানের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে আসছে। এইখানেই আমার কষ্ট। আমি তো এটা চাইনি। তাহলে কেনো এমন হোল?
-- উনি এখানে এলে তুমি জেনে নিও, দাদা।
-- না এতদিন যখন জানতে চাই নি, তখন, এই শেষ বয়সে জেনে তাকে কষ্ট দিয়ে কি হবে? আমি আপনাদের কাছে একটা রিকোয়েস্ট করতে চাইআপনারাও কেউ এ ব্যাপারে জানতে চাইবেন না ,প্লীজ।
-- বেশ, তুমি যখন বলছ, আমরা তোমাকে কথা দিলাম।
-- সেই দিন আমি যখন বাড়ি ফিরি, মা বাবা দুজনেই বসে ছিলেন আমার মুখ থেকে সুখবরটা শোনার জন্য। কিন্তু, আমার মুখ থেকে সব শুনে বাবা বলেছিলেন, তিনি যাবেন, স্বর্ণলতাদের বাড়ি। আমিই বারণ করি। তাতে মা - বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন, এই একটা যায়গায় আমি বাবা - মাকে কষ্ট দিয়েছিলাম। ওই ঘটনার পরেই আমি ট্রান্সফার নিয়ে দিল্লী চলে যাই। বছর তিনেক পরে যখন আমি কলকাতায় ফিরি, তখন স্বর্ণর বিয়ে হয়ে গেছে, এক ছেলের মা হয়ে গেছে। এ খবরটা আমাকে আমার এক বন্ধু দিয়েছিল। আমি খুব খুশি হয়েছিলাম স্বর্ণর কথা শুনে। ও ভালো আছে  শুনে, ও সুখে আছে শুনে, ভালো লেগেছিল।   
তারপর বাবা মা আমার বিয়ে করার জন্য অনেক বার বলেছেন, অনেক চেষ্টা করেছিলেন ছেলের বিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু আমি রাজি হই নি। কারণ, স্বর্ণকে যে যায়গায় বসিয়েছি সেখানে আর কাউকে তো বসাতে পারবো না। যদি আমি সে দিন অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করতাম, তাতে সেই মেয়েটির প্রতি অন্যায় করা হতো না? সে আমার কাছে কৈফিয়ত চাইতো। সে তো আমাকে সম্পূর্ণ ভাবে পেতো না। তাহলে তার সাথে অবিচার করা হতো, তাই  না? আমি জানি, আমার এই বিয়ে না করার জন্য বাবা মা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। আমি তাঁদের বংশধর দিতে পারবো না জেনেই হোক আর আমাতে দাস বংশ শেষ হবে জেনেই হোক, তাঁরা আর বেশী দিন বাঁচেন নি। এই একটা যায়গায় আমি আপনাদের ছেলে মেয়েদের সমান। আমি পারিনি বাবা মাকে সুখে রাখতে। এই ব্যাপারে আমি বাবা মায়ের অবাধ্য হয়েছিলাম। যাক, এখানেই শেষ স্বর্ণর কথা। সেই শেষ দিনের পর কাল যদি ও আসে তবে প্রায় ৩৭ বছর পর দেখা হবে।    
-- নির্মলা, পরশু স্বর্ণলতা-দেবী আসছেন তো?  
-- হ্যাঁ, অমলদা, এখনও অবধি সেই কথাই আছে, তবে উনি একাই আসবেন, এই ১০টা-সারে ১০টা নাগাদ। ছেলে দিতে আসবে না।  
-- সে না আসুক গে, আমরা তো আছি। আমরা ঠিক করেছি, আমাদের তরফ থেকে, স্বর্ণলতা দেবীকে তাঁর জন্ম দিনের শুভেচ্ছা জানাব।
-- বেশ, আপনারা আপনাদের মতো করুন, আমি আমার মতো করবো। হরি, মনে আছে তো কাল খুব ভোরে গিয়ে ফুলের অর্ডার দিতে হবে?
-- হ্যাঁ, বাবু মনে আছে, আমি ঠিক আপনাকে ডেকে তুলে দেব।  
-- তুমি ফুলের অর্ডার দিচ্ছ নাকি অয়ন?
-- হ্যাঁ, অমল, কেনো? তোমাদের লাগবে?
-- হ্যাঁ,
-- বেশ, আমি কাল বলে আসবো, তোমাদের জন্য,
-- আমিও যাবো তোমার সাথে,-- মুকুল বাবু বলেন।
--বেশ, যেও।

সবার খাওয়া হয়ে গেলে, যে যার ঘরে চলে যায় বিশ্রাম নিতে। ৩টের সময় কেবল টিভির ছেলেরা, আর তার সাথে, ইলেক্ট্রিশিয়ানরাও আসে এ,সির লাইন ঠিক করে দেবে বলে। হরি ওদের নিয়ে সবার ঘরে টিভি গুলো লাগাতে চলে যায়। ঠাকুর সবাইকে চা বিস্কুট এনে দেয়। চা খেতে খেতে কোথায় কোথায়  ফুল লাগানো হবে সেটা ঠিক করে, আর সেই ফুল লাগাবার দায়িত্বটা সবাই অমল বাবুকে দেয়। অমল বাবু রাজি হয়ে যায়। রাতে মাংস লুচি খেয়ে। অনেক রাত অবধি সবাই গল্প গুজব করে ঘুমাতে যায়।

চার

       পরের দিনটাও হৈ হৈ করে কেটে যায়। অয়ন সাতে অবলম্বনে যেন একটা খুশির হাওয়া বয় সব সময়। পরের দিন খুব ভোরে অয়ন, মুকুল বাবু  আর হরি, তিনজনে মিলে ফুল নিয়ে আসে, তখনও সবাই ওঠেনি, তখনও দু-একজন উঠতে বাকি। ফুল সাজাবার জন্য, দুটো লোক আসে, তাদেরকে অমল বাবুর কাছে পাঠিয়ে দেয়। অমল বাবু ওদের নিয়ে ফুল লাগাতে লেগে পরে। অয়ন ঠাকুরকে চা দিতে বলে। ঠাকুর চা দিলে, চা খেয়েঅয়ন ঠাকুর কে বলে--তোমার কী কী লাগবে ঠাকুর হরি কে বলে দাও। ঠাকুর হরিকে একটা চিরকুট ধরিয়ে দেয়। অয়ন হরিকে নিয়ে বাজারে চলে যায়। অয়ন বাজার থেকে সব সেরা সেরা জিনিস গুলো তুলে নিয়ে আসে। অয়নদের সব গুছিয়ে নিয়ে আসতে প্রায় পৌনে ১০টা হয়ে যায়। অবলম্বনের কাছে এসে দেখে, একটা ট্যাক্সি থেকে স্বর্ণলতা নামছে।  অয়ন গাড়ীটাকে একটু দূরে রেখে, হরিকে বলে
-- হরি যা, ওই যে যার আসার কথা ছিল, সে এসে গেছে, তুই দৌড়ে গিয়ে সুটকেসটা আর ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে দিয়ে আয়, আমি পরে যাচ্ছি।
হরি তাড়াতাড়ি নেমে এগিয়ে যায়। অয়ন পিছন থেকে বলে
-- আর শোন, ভেতরের সবাইকে বলে দে, আমার কথা না বোলতে।
-- ঠিক আছে বাবু, -- হরি ঘার নেরে সায় দেয়।
হরি এগিয়ে গিয়ে স্বর্ণলতার ব্যাগ আর সুটকেস নিয়ে বলে
-- আসুন মা, ভেতরে আসুন।
-- তুমি? তুমি কে?
-- আমি হরি, আমি এখানেই কাজ করি।
-- হরি, তোমাদের নির্মলা দিদিমণি কোথায়?
-- উনি ভেতরে আছেন, আসলে হয়েছে কী মা, কাল সব ঘরে এ,সি লাগানো হয়েছে তো, তাই অফিসের দরজাটা কাঁচের করা হয়েছে, তাই কেউ আপনার গাড়ীর আওয়াজ শুনতে পায় নি, আপনি আমার সাথে ভেতরে আসুন।
হরি, স্বর্ণলতাকে নিয়ে কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে নিয়ে যায়। স্বর্ণলতাকে দেখে সবাই হৈ হৈ করে ওঠে। সবাই তাকে গোলাপ ফুল দিয়ে, জন্ম দিনের শুভেচ্ছা জানায়।
স্বর্ণলতা অবাক হয়ে যায় সবার এই আন্তরিকতা দেখে, কিন্তু তার আজ জন্ম দিন এটা কী করে জানলো এরা? আর গোলাপ? তার প্রিয় ফুলটার কথাই বা  জানলো কী করে
-- একটা কথা নির্মলা, তোমারা জানলে কী করে, আজ আমার জন্ম দিন, তোমাদের ফর্মে তো আমার জন্ম তারিখ যেটা দেওয়া আছে, সেটা তো ভুল, তাহলে?
-- আছে একজন, যিনি আপনার সব কথা আমাদের বলেছেন।
-- আছে একজন! কে? কে সে? যে আমাকে জানে, আমাকে চেনে। শুধু তাই নয়, সে আমার আসল জন্ম দিন পর্যন্ত জানে। বলো, কে সে?
সবাই অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কেউ কোনো কথা বলে না, সবাই এর ওর মুখের দিকে তাকায়, কারণ অয়ন যে বলে দিয়েছে, তার নাম না বোলতে। কী করে বলে।
ঠাকুর জলখাবার নিয়ে এসে বলেআসুন মা জলখাবার খেয়ে নিন, লুচি ঠাণ্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না। আপনারাও আসুন, সকাল থেকে কারুর খাওয়া হয়নি। 
-- না, আমি খাব না। যতক্ষণ না তোমরা বলছ, কে বলেছে, আমার কথা, ততক্ষণ, আমি খাব না।---স্বর্ণলতা বলে ওঠে
সবাই অপ্রস্তুত হয়ে যায়। অয়ন, বাইরে থেকে দেখছিল, ওদের কথা শুনছিল,-- আর ভাবছিল, তার স্বর্ণলতার সেই জেদ এখনও আছে, মনে মনে হাসে।
অয়ন, সবাইকে অপ্রস্তুতের হাত থেকে বাঁচায়, এবার এগিয়ে এসে কাঁচের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে স্বর্ণলতাকে বলে – 
-- আমি বলেছি স্বর্ণ,
সেই কবে কার চেনা গলার স্বর, আজ আবার শুনতে পেল, তার মনে হোল তার অয়ন যেন তার কাছে এসেছে, তাকে স্বর্ণ বলে ডাকল, কিন্তু, কোথায় সেতাকে তো দেখতে পাচ্ছিনা। তবে কী কানে ভুল শুনলাম।
-- কে? কে বললেন,কথাটা?
-- আমি। এখনও সেই জেদ।
অয়ন সামনে এসে বলে। অয়নকে দেখে স্বর্ণলতা অবাক হয়
-- কেমন আছো স্বর্ণ। 
-- অয়ন! তুমি! তুমি এখানে?
-- এই প্রশ্নটা তো আমিও তোমাকে করতে পারি, স্বর্ণ। 
-- আমার আর কোথাও যাবার যায়গা নেই যে।
-- কিন্তু কেনো?
-- আমার ছেলে আমাকে তার কাছে রাখতে চায় না তাই। কিন্তু তুমি এখানে কেন?
-- এখন থেকে আমি এখানেই থাকবো, এদের সাথে।
-- কিন্তু কেন? তোমার স্ত্রী, ছেলে মেয়ে, এরা কোথায়? তারাও কী আমার ছেলের মতো তোমাকে যায়গা দিলো না?
অয়ন, কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকে স্বর্ণর দিকে, ভাবে তাকে বলবে না কি বলবে না, যে সে বিয়ে করেনি।
-- বাবু আপনার জলখাবার দিয়েছি, ---ঠাকুর এসে বলে,
অয়ন কথাটা চেপে গিয়ে, স্বর্ণকে বলে
--চলো, টিফিন খেয়ে কথা বলা যাবে।
-- হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই চলো অয়ন, খেতে খেতে কথা বলা যাবে।
সবাই এসে খাবার টেবিলে এসে বসে। ঠাকুর, সবাইকে লুচি আলুর দম, বেগুন  ভাজা, মিষ্টি, দিয়ে যায়। সবাই খেতে থাকে। 

স্বর্ণলতাকে দেখে অয়নের হল, সে খুব একটা ভালো নেই, সেটা শারীরিক ভাবেই হোক, আর মানসিক ভাবেই হোক, অথবা আর্থিক ভাবেই হোক। পরনের শাড়ীটা খুব একটা দামী বা ভালো নয়। সেটা অবশ্যই তার ছেলের দোষ। যে ছেলে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যায় সে যে কত দামী শাড়ি মাকে পরাবে, সেটা ভাববার কথা।       
স্বর্ণলতা একটা লুচি ছিঁড়ে আলুর দম দিয়ে খেতে গিয়ে থমকে যায়। তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরে। তার নাতিটা আলুর দম খেতে খুব ভালবাসে,তার মুখটা মনে পরে যায়। সে খেতে পারে না। অয়ন লক্ষ করে, স্বর্ণ খাচ্ছে না, চুপ করে বসে আছে। সে স্বর্ণলতার একটা হাতের ওপর তার হাতটা রেখে বলে
-- কী হোল স্বর্ণ, খাচ্ছোনা কেন? খাও।
স্বর্ণলতা মুখ তুলে অয়নের দিকে তাকায়, অয়ন, তার চোখে জল দেখে, কষ্ট হয়। অয়ন,
-- কারুর কথা মনে পড়ছে, স্বর্ণ?
-- হ্যাঁ, আমার ছোট নাতিটার কথা মনে পড়ছে। সে আলুর দম খেতে খুব ভালবাসে, সে আবার ঠিক মতো কথা বলতে পারে না, কী বলে জানো? বলে -- তাম্মি, “আউর গমথাবো-- আলুকে আউআর খাবোকে থাবোবলে। জল খাবো কে বলে দল খাবো”--এই বলে স্বর্ণলতা হেসে ওঠে। স্বর্ণর সাথে সাথে সবাই হেসে ওঠে। অমল বাবু বলে
-- হ্যাঁ, আমার নাতনিটাও তাই, এই একটা যায়গায় আমাদের দুর্বলতা, কিছুতেই এদের ভুলতে পারি না। কী আর করা যাবে, ভবিতব্যকে মেনে নিতেই  হবে। শত কষ্টকে বুকে চেপে রেখে যে কটা দিন বাঁচি, ওদের মুখটা, ওদের ওই আধো আধো কথা গুলোভেবেই কাটাতে হবে।    
অয়ন, স্বর্ণলতাকে বলে --ঠিক আছে আলুর দম না খাও, বেগুন ভাজা দিয়ে খাও।
-- তোমার কারুর কথা মনে পড়ে না, অয়ন
-- কে বলল পরে না? মনে পড়ে তো?
-- কার কথা মনে পড়ে?
-- আমার কথা বিশ্বাস করবে?
-- কেন করবো না? বলো।
-- যদি বলি—“তোমার
স্বর্ণলতা হেসে ফেলে বলে -- কেন, তোমার স্ত্রী, ছেলে মেয়ে, নাতি নাতনিদের কথা মনে পড়ে না
অয়ন কিছুক্ষণ স্বর্ণলতার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে। তারপর বলে-
-- আমি তো বিয়ে করিনি স্বর্ণ।
-- কী? তুমি বিয়ে করনি?
অয়নের কথা শুনে স্বর্ণলতা অবাক হয়ে যায়। তাহলে কী তার জন্যই অয়ন বিয়ে করেনি? তার মনে পড়ে যায় সেই শেষ দিনের কথা, অয়ন যে দিন তার বাবার সাথে কথা বলতে গেছিল, সেই দিন, বাবার সাথে তার অয়নকে বিয়ে করা নিয়ে অনেক কথা কাটা কাটি হয়েছিল। বাবা কিছুতেই রাজি হয়নি তার অয়নকে বিয়ের ব্যাপারে। বাবা বরাবর আপত্তি করে এসেছে অয়নের একটা ব্যাপারে। সেটা সে অয়নকে বোলতে পারেনি। সেটা হল, অয়নের জাত নিয়ে। অয়নরা নাকি জাতে নাপিত”- আর তারা ব্রাহ্মণবাবাকে কিছুতেই মানাতে পারেনি সেদিন। শেষে বাবা বলে বসে- যদি সে অয়নকে বিয়ে করে, তাহলে বাবা সুইসাইড করবেআর পারেনি  সে, হেরে গেছে। সে চায় নি বাবার মৃত্যুর কারণ হতে, সেদিন, তাই অয়নকে বাড়ির দরজা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
-- কেন? বিয়ে করনি কেন?  
-- সে কথা না হয় পড়ে বলবো। এখন খেয়ে নাও। অনেক বেলা হয়ে গেছে।
সবাই খাওয়া শেষ করে, অফিসের বসার ঘরে এসে বসে গল্প করতে থাকে।  অয়ন, স্বর্ণলতাকে বলে
-- যদি তুমি কিছু না মনে কর, একটা কথা বলবো?
-- তুমি যা বলবে, তাতে মনে করার কি আছে। বলো, কি বলবে।
-- মার সমস্ত গহনা গুলো আমার কাছে আছে, সে গুলো আমি তোমাকে দিতে চাই, তুমি নেবে?
-- তোমার মার গহনা আমি নেবো কেন?
-- মা সে গুলো তার বৌমাকে দেবার জন্য রেখে দিয়েছিলেন। সে সৌভাগ্য তো তার হল না, যদি তুমি নাও, অন্তত মা এইটুকু ভেবে সান্ত্বনা পাবে যে তার গহনা গুলো তোমার কাছে আছে।
আমল বাবু শুনছিলেন ওদের কথা, তিনি স্বর্ণলতাকে বলেনধরে নিন মাসিমার বৌমার কাছেই গেলো তাঁর গহনা গুলো। আর, এক দিন তো আপনারই তাঁর বৌমা হবার কথা ছিল।
-- আপনি কি করে জানলেন?
-- আমরা আপনার সব কথা জানি। অয়ন সব বলেছে।
স্বর্ণলতা লজ্জা পেয়ে যায় অমল বাবুর কথা শুনে। চুপ করে থাকে।
-- আমার ইচ্ছা তুমি আজ সন্ধ্যায় ওই গহনা গুলো পরে জন্মদিনের কেক কাটো।    
--বেশ, দিও। কিন্তু তুমি বিয়ে করনি কেন, অয়ন?
-- বিয়ে করিনি কারণ, আমার জীবনের যে যায়গায় তোমাকে বসিয়ে ছিলাম, সেখানে যে আর কাউকে বসাতে পারিনি, আর পারবোনা কোনো দিন।
স্বর্ণলতা, চুপ করে ভাবে, তার জন্যই অয়ন বিয়ে করেনি। সে কত বড় একটা অন্যায় করেছিলো? নিজেকে অপরাধী মনে হল, বাবার দিকটা দেখতে গিয়ে সে অয়নের দিকটা একটুও ভাবল না? অয়নকে বাড়ির বাইরে থেকেই তাড়িয়ে দিয়েছিলো। একবারও ভাবেনি অয়ন, কতটা কষ্ট পাবে? কতটা কষ্ট পাবে অয়নের বাবামা? কি করে ক্ষমা চাইবে সেই দুটি মানুষের কাছে? যারা তাকে এতো ভালবাসতেন। আমি ওদের বাড়ি গেলে কত খুশি হতেন। আর আমি কিনা?  
-- কি ভাবছ, স্বর্ণ,
-- কিছুনা, বল যা বলছিলে।
-- আমি বিয়ে করলে, সেই মেয়েটির প্রতি অবিচার করা হতো না? একদিন না একদিন জানতে পারত তোমার কথা। তখন সে যদি জিঙ্গাসা করতো আমি তোমাকে ছেড়ে তাকে বিয়ে করলাম কেন? কী উত্তর দিতাম আমি? শুধু তাই নয়, সে কী আমাকে স্বামী হিসাবে সম্পূর্ণ ভাবে পেতো? আমার মনে যে যায়গা তোমার জন্য আছে, সেখান থেকে তোমাকে সরিয়ে আর একজনকে কি সেখানে বসাতে পারতাম? হয়তো, আমরা স্বামী-স্ত্রী হিসাবে থাকতাম, কিন্তুকোথাও একটা ফাঁকা যায়গার সৃষ্টি বা গ্যাপ রয়ে যেতো না? বিবাহ কি শুধু শারীরিক প্রয়োজনতাকেই প্রাধান্য দেয়? মানসিক ভাবে দেয়া-নেয়ার কোনো স্থান নেই? শারীরিক প্রয়োজন তো বেশ্যারাও মেটায়, তাহলে কোনো মেয়েকে বিয়ে করা আর বেশ্যার সাথে সহবাস করা কী এক
-- কিন্তু অয়নবিয়ের পর দুটি নর নারীর শারীরিক সম্পর্কের প্রয়োজনও যে আছে, সেটা তুমি অস্বীকার করতে পার না।---- অমল বাবু বলেন।
-- হ্যাঁ, অমল, আমি জানি প্রয়োজন আছে শারীরিক সম্পর্কের, কিন্তু, সেটাই যে সব তা তো নয়? মন, ভালবাসা, বিশ্বাস এগুলোর কি কোনো দাম নেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে? সবই কি শারীরেই সীমাবদ্ধ? আমি যদি কোনো মেয়ে কে বিয়ে করতাম, আমার মন, আমার ভালবাসা সে কি পেতআর তার বিশ্বাস? স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাসটাই সব থেকে বড়। তার বিশ্বাসের মর্যাদা আমি কি দিতে পারতাম? না,পারতাম না। তাই আমি জেনে বুঝে,  তাকে এই অবহেলা করতে হবে বলেই বিয়ে করিনি।
-- তুমি জানতে চাইবে না, কেন সেদিন তোমায় আমি তাড়িয়ে দিয়েছিলাম?
-- না, তার আর প্রয়োজন নেই, সেদিন যখন জানতে চাই নি, আজ ৩৭ বছর পর জেনে কী হবে, স্বর্ণ? থাক না সে সব কথা।
-- কিন্তু
-- আর কোনো কিন্তু নয় স্বর্ণ। এই নিয়ে আর কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। অয়ন একটু থেমে আবার বলে
-- আচ্ছা স্বর্ণ? আমার একটা কথার উত্তর দেবে? সেদিন তুমি আমাকে  ভালবাসতে, আমিও তোমাকে ভালবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। হ্যাঁ আর না?
-- হ্যাঁ,
-- আমিও, আর ঠিক এই কারণেই তোমার ভালবাসাকে প্রাধান্য দিয়েছিলাম। তুমি চেয়েছিলে আমি চলে যাই, চলে গেছি, ব্যাস, that’s enough আর কিছুই তো জানার দরকার নেই আমার।
-- কিন্তু তোমার ভালবাসাকে, বা তোমার চাওয়াকে তো আমি প্রাধান্য দিতে পারিনি। আমি প্রাধান্য দিয়েছি বাবার চাওয়াকে। আমি কেন পারলাম না, তোমার ভালবাসাকে, তোমার চাওয়াকে প্রাধান্য দিতে?
-- যে কোনো একজনের চাওয়াকে তোমায় বেছে নিতে হতো, তুমি তাই করেছতুমি সেটাই করেছো, যেটা তোমার করা উচিৎ। তুমি তোমার বাবার চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়েছ, তাতে তো তোমার কোনো দোষ দেখি না। আর এটা নিয়ে এখন মন খারাপ করো না।
-- আমার একটা প্রস্তাব ছিল তোমাদের কাছে, তবে এ প্রস্তাবটা সবার, আমার একার নয়। যদি অনুমতি কর, তবে বলি। -- অমল বাবু বলেন,
-- বলুন না আপনারা কী বলবেন? অনুমতি নেওয়ার কী আছে? --স্বর্ণলতা বলে--
-- আমাদের ইচ্ছা, তোমরা আবার এক হয়ে যাও।
-- বুঝলাম না আপনাদের কথা, কী বোলতে চাইছেন?
-- আমরা বোলতে চাইছি যে তোমরা বিয়ে করে নাও।
-- কি, যা তা বকছ, অমল? –অয়ন বলে ওঠে।   
-- কেন, খুব ভুল বললাম? তোমরা বিয়ে করতে পার না?
-- বিয়ের কথা আসছে কোথা থেকে?
-- কেন? স্বর্ণলতা, তুমি বলো? আমি কি খুব একটা ভুল বলেছি?
স্বর্ণলতা, ভেবে পায় না কি বলবে। একটু ভেবে সে বলে— 
--বিয়ে? এই বয়সে? তা হয় নাকি?
-- তোমাদের বিয়ের সাথে বয়সের কোনো সম্পর্ক আছে না কি
-- আর তার দরকারই বা কি? – অয়ন বলে
-- কেন? তোমার কথা অনুযায়ী, তোমাদের তো আর এই বুড়ো বয়সে আর শারীরিক প্রেমের প্রয়োজন নেই, তোমাদের সেই ৩৭ বছরের আগেকার প্রেমের প্রয়োজন আছে। তোমাদের দুজনের মনের মিলনের প্রয়োজন আছে। কারণ, তোমরা দুজনেই অসুখী।
-- কিন্তু, মনের মিলনের জন্য কি বিয়ে করা প্রয়োজন আছে? আমার তা মনে হয় না, প্রয়োজন আছে। আমরা তো এখানে দুজনেই থাকবো, রোজ কথা হবে, তাহলে বিয়ে কেন? ---স্বর্ণলতা বলে-
-- কারণ তো একটু আগেই, তুমি বলে দিয়েছ, স্বর্ণলতা।
-- আমি? কখন বললাম?
-- একটু আগে তুমি অয়নকে বলছিলে না, যে তুমি কেন পারলে না অয়নের ইচ্ছাকে, অয়নের ভালবাসাকে প্রাধান্য দিতে?
-- হ্যাঁ, বলেছি, তাতে কি?
-- আজ যখন সময়, সুযোগ এসেছে তোমরা কেন তার সৎ ব্যাবহার করবে না? সে দিন পার নি কারণ তোমার বাবা ছিলেন, আজ তো তোমার বাবা নেই, তাহলে, তুমি অয়নের ইচ্ছাকে পূরণ করতে পার। 
অয়ন, স্বর্ণলতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, স্বর্ণলতার মুখে একটা আলো আঁধারির খেলা দেখতে পায়, একটা উজ্জ্বলতা লক্ষ্য করে। তবে কি? স্বর্ণলতাও মনে মনে চাইছে তারা বিয়ে করুক। কিন্তু
-- বাবা না থাক ছেলে তো আছে। সে কী ভাববে। তার মা পুড়ান প্রেমিক কে বিয়ে করলো, এই বুড়ো বয়সে। ছিঃ, সে যে ভীষণ লজ্জার হবে, অপমানের হবে, অমল। --অয়ন বলে। 
-- তার আবার ভাববার কী আছে, সে তো তার মাকে আর এক জনের অবলম্বনে পাঠিয়ে দিয়েছে। তার আর কোনো অধিকার নেই আপত্তি করার। আচ্ছা, তোমার ছেলে যদি তোমাকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয় তুমি কি করবে, স্বর্ণলতা?
-- তাহলে আমাকে ভিক্ষা করতে হবে। --স্বর্ণলতার মুখটা নিচু করে অনেক কষ্টে উত্তর দেয়। তার চোখ জলে ভিজে ওঠে।
এই কথাটা শোনার পর অয়ন একটু বিচলিত হয়, তার মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েমনের মধ্যে কোথাও একটা সূক্ষ্ম কাঁটা বিঁধছে। তার স্বর্ণ, ভিক্ষা করবে? অসম্ভব, এ  হতে পারে না। সে এটা কিছুতেই হতে দেবে না।
-- সেটা বুঝি খুব সম্মানের হবে, তোমার আর অয়নের পক্ষে? যেখানে তোমাদের দুজনের ভালবাসার কথা আমরা জানার পর।
-- না তা হবে না, কিন্তু
-- আর কোনো কিন্তু নয়, আরে এতদিন তো অন্যের জন্য বেঁচেছ, আজ থেকে নিজেদের জন্য একটু বাঁচো না, আর কদিনই বা বাঁচবে?
স্বর্ণলতা মাথা নিচু করে ভাবে। অনেক ভেবে উত্তর দেয়
-- বেশ আমি রাজি।
অয়ন চমকে স্বর্ণলতার দিকে তাকায়, স্বর্ণ রাজি হয়ে গেল বিয়ের জন্য। সে যা ভেবেছিল তাই হোল।
-- তুমি কী বলো অয়ন?--- অমল বাবু জিঙ্গাসা করেন
অয়ন চিন্তা না করেই উত্তর দেয়।
-- স্বর্ণলতা যখন রাজি তখন---
অয়নের কথা শেষ না হতেই সবাই হৈ হৈ করে চেঁচিয়ে ওঠে।
ঠাকুর এসে বলে -- আপনারা সবাই স্নান সেরে আসুন, আমার রান্না শেষ।
অমল বাবু নিজের ঘড়ি দেখে বলে-- ওরে বাবা,দেড়টা বেজে গেছে, কথায় কথায় অনেক বেলা হয়ে গেছে। তাহলে ওই কথাই রইল। তোমরা সবাই মিলে একটা দিন ঠিক কর। এবার চলো, চলো সবাই। 
-- আমার কোন ঘরটা? আমাকে দেখিয়ে দাও।---স্বর্ণলতা নির্মলাকে বলে।
-- ওই তো, দাদার ঘরের ঠিক উল্টো দিকের ঘরটা,
-- তুমি এসো স্বর্ণ, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি, --- অয়ন বলে।
সবাই যে যার ঘরে চলে যায়, অয়ন আর স্বর্ণলতাও সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যায়। স্বর্ণলতাকে ঘর দেখিয়ে দিয়ে, সে নিজের ঘরে গিয়ে, সোফায় বসে ভাবে, স্বর্ণ এটা কী করলো? সে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলো, তার বাবাকে দেওয়া কথা সে রাখতে পারলো না? সে কী insecure fill করছে? যদি তার ছেলে তাকে টাকা না পাঠায়, তাই, সে বিয়েতে রাজি হয়ে গেল? আমি তো তা হতে দেব না। থাক এ নিয়ে পড়ে ভাবা যাবে, এখন খিদে পেয়েছে। স্নানটা সেরে খেয়ে নিই। অয়ন তোয়ালেটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়।

পাঁচ

ওদিকে স্বর্ণলতা নিজের ঘরে ঢুকে, গামছাটা নিয়ে, বাথরুমে যেতে গিয়ে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে ভাবে, অয়ন সে একই রকম আছে। চুলে পাক ধরেছে ,তার ৫৯ বছরের চুলেও তো পাক ধরেছে। কিন্তু তার দেখা সেই ৩৭ বছর আগের তার অয়ন মনে প্রাণে আমাকেই ভালবাসে, আর ভালবাসে বলেই সে বিয়েতে রাজি হয়েছে। আর সে, সে কী অয়নকে এখনও ভালবাসে? মনের কোনে কী অয়নের জন্য কোনো যায়গা রেখেছে? যদি সে এখনও অয়নকে ভালবাসে, তাহলে সে তো তার স্বামীর সাথে দ্বীচারিতা করেছে। মনে পড়ে যায়, বিয়ের পর প্রথম প্রথম স্বামীর সাথে ভালো করে কথা বলতো না। যদিও কাজের চাপে ঘরে থাকতো কম। শুধু রাতের সময় ছিলো, তার ভালবাসার সময়। যে ভালবাসাতে তার কোনো সায় ছিল না। ফুলসজ্জার রাতে তাকে সে গ্রহণ করেনি, সে তার স্বামীকে জানিয়ে দিয়েছিল তার দেহজ ভালবাসায় সারা  না দিয়ে। তার স্বামী তার দেহটাকে নিয়ে একা একাই নিজের মতো করে খেলেছে। সে খেলায় তার কোনো সহযোগিতা ছিল না। আর তার ফল স্বরূপ তার এই একটি ছেলে। সেও আজ পর করে দিয়েছে। রইল না তো কেউ, তার পাশে। এখানে এসে সেই ৩৭ বছরের আগের একজন, তার অয়নকে সে পাশে পেলসেদিনের মতো তাকে চলে যেতে বলতে পারছে না কেনতাকে অস্বীকার করতে পারছে না কেন? অয়নকে দেখে লোভ  হয়েছে? কীসের লোভ? নাকি অয়ন তার ৩২ বছরের শুকিয়ে যাওয়া প্রেমের, তার ভালবাসার সঞ্জীবনী? তাই কী অয়নকে দেখা মাত্র, একটা সজীবতার মৃদু হাওয়া মনে বোয়ে গেছিলো? একটা অস্পষ্ট চাওয়ার অনুভূতি, একটা
দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ শুনে স্বর্ণলতার চিন্তায় ছেদ পড়ে। সে তাড়াতাড়ি উত্তর দেয়
-- কে?
-- আমি অয়ন, তোমার হয়েছে?
-- হ্যাঁ, হ্যাঁ, হয়েছে, তুমি নিচে যাও। আমি এখনই আসছি।
-- ঠিক আছে, এসো।
অয়ন বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়ায়। স্বর্ণলতা তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে, হাত মুখ ধুয়ে নেয়, সে বাড়ি থেকে স্নান সেরেই এসেছিলো। যে শাড়ীটা পরেছিল সেটা না পাল্টে, দরজা খুলে বাইরে আসে। দরজার আওয়াজ শুনে অয়ন ঘুরে দাঁড়ায়। অয়নকে দেখে স্বর্ণলতা বলে
-- তুমি নিচে যাও নি, এখানে দাঁড়িয়ে।
-- হ্যাঁ, তোমার জন্যই দাঁড়িয়ে, চলো নিচে যাই।
-- হ্যাঁ, চলো।
অয়ন দু'পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, স্বর্ণলতার দিকে তাকিয়ে। তার সেই সকালের শাড়ীটাই পড়া। অয়নকে দাঁড়াতে দেখে, স্বর্ণলতা জিঙ্গাসা করে
-- কী, হোল, দাঁড়ালে কেন?
-- একটা কথার উত্তর দেবে স্বর্ণ?
-- বলো
-- তোমার আর কোনো ভালো শাড়ি নেই না?
স্বর্ণলতা, চমকে যায় অয়নের কথা শুনে। ঠিক সে একই রকম আছে তার ওপর অয়নের নজর। এতটুকুও নজর এরায় নি। সে ঠিক ধরেছে। তার এই একটাই ভালো শাড়ি। কোথাও যেতে আস্তে এই শাড়ীটাই পড়ে।
-- না, মানে, হ্যাঁ, মানে না।স্বর্ণলতা আমতা আমতা করে বলে। সে মাথা নিচু করে নেয়, তার চোখ ভিজে যায়।
-- থাক বিঝতে পেরেছি। আমি কিনে দিলে নেবে স্বর্ণ?
-- তোমার নজর এরায়-নি, তুমি ঠিক সেই আগের মতোই আছো। তুমি আমায় কিনে দিলে, আমি কোনো দিন না বলেছি অয়ন?
-- বেশ, তাহলে খাওয়া হলে আমরা বেরুব,
-- বেশ তাই হবে।
ওরা নিচে নেমে এসে দ্যাখে, সবাই তখনও আসেনি। সবাই এলে, খাবার টেবিলে এসে খেতে বসে। আজ অয়ন, ইলিশ মাছ খায়। ইলিশ মাছ দেখে স্বর্ণলতা খুব খুশি হয়। তুমি কিছুই ভোল নি অয়ন। তুমি ঠিক মনে রেখেছও, আমি ইলিশ মাছ ভালবাসি।
-- শুধু কি মনে রাখা? তুমি জানো? তুমি আজ আসবে বলে গত পরশু দিন ও ইলিশ মাছ খায় নি।অমল বাবু বলে।  
স্বর্ণলতা ভাবে অয়ন এখনও আমাকে এতটা ভালোবাসে?  
কেউ আর কথা না বলে খেয়ে নেয়। খাওয়া হয়ে গেলে, অয়ন স্বর্ণলতাকে নিয়ে, তার কাপড় কিনতে যায়। ঘণ্টা দেড়েক পরে ফেরে।
অয়ন নিজের ঘর থেকে তার মার গহনা গুলো স্বর্ণলতাকে দিয়ে আসে। নিজের ঘরে এসে সে, একটু রেস্ট নেয়, আর স্বর্ণলতার কথা ভাবে, অনেক ভেবে সে তার সিদ্ধান্ত  জানিয়ে স্বর্ণলতা একটা চিঠি লেখে। চিঠিটা টেবিলের ওপরে গোলাপের ফুলদানির নিচে চাপা দিয়ে রাখে।  ঠিক সাড়ে ৫টার সময় অয়ন তার নতুন সুটটা পড়ে। আর  তার ব্যাঙ্কের সমস্ত কাগজ গুলো আর আলমারি থেকে যেটুকু টাকা ছিল তা সবই, তার কোটের পকেটে ঢুকিয়ে  নেয়। তারপর, সে নিচে নেমে আসে। স্বর্ণলতা তখনও নিচে আসেনি দেখে, নির্মলাকে ওপরে পাঠায়, স্বর্ণলতাকে সাজিয়ে নিয়ে আসার জন্য।
-- তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোর না দাদা, আমি সাজিয়ে নিয়ে আসছি।
-- ঠিক আছে, যা
ঠাকুর কে বলেএক কাপ চা খাওয়াবে ঠাকুর।
ঠাকুর চা দিয়ে যায়, অয়ন চা খেতে খেতে সবার সাথে কথা বোলতে থাকে, আধ ঘণ্টা পরে নির্মলা, স্বর্ণলতাকে  অয়নের মায়ের গহনা গুলো পড়িয়ে, সাজিয়ে নিয়ে আসে। নিচে এসে অয়নকে বলে
-- দ্যাখ তো দাদা কেমন লাগছে, আমাদের বৌদিকে,
অয়ন ঘুরে স্বর্ণলতার দিকে তাকিয়ে বলে
-- বাহ, খুব সুন্দর লাগছে তোমায় স্বর্ণ।
অয়ন একটু কৌতুক করে বলে
-- ওর গালে একটু কাজলের টিপ দিয়ে দে, না হলে নজর লেগে যাবে, -- বলেই নিজেই হো হো করে প্রাণ খুলে হেসে ওঠে, তার সাথে সাথে সবাই জোরে হেসে ওঠে। স্বর্ণলতা লজ্জা পেয়ে অয়নকে বলে
-- ইয়ার্কি, হচ্ছে না? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা।
-- Sorry, Sorry, -- কিন্তু তোমাকে, সত্যি তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।

অয়ন মনে মনে ভাবে তোমার নজর লেগে গেছে স্বর্ণলতা। সেটা তুমি একটু পরেই বুঝতে পারবে। আমার নজর লেগেছে তোমার, তাইতো আমার শেষ ইচ্ছা আমি নিজেই পুড়ন করতে চলেছি, একটু পরেই। 
অয়নের কথা শুনে, এবার স্বর্ণলতা সত্যি লজ্জা পেয়ে যায়। অয়ন হটাৎ সবাইকে বলে
-- আমাকে একটু বেরুতে হবে, তোমরা একটু অপেক্ষা কর ,আমি এখনই আসছি।
-- কোথায় যাচ্ছ দাদা?
-- আমি একটু বাজারে যাব।
-- কেন? বাজারে যাবে কেন?---স্বর্ণলতা জিঙ্গাসা করে 
-- ফুলের দোকানে যাব, তোমার জন্য ফুল আনতে।
-- বেশ, কিন্তু যাও তাড়াতাড়ি আসবে কিন্তু।
-- ঠিক আছে, আমি যাব আর আসব। আমি এলে তোমার কেক কাটা হবে।

ছয়

অয়ন বেড়িয়ে আসে অবলম্বন থেকে, গেটের কাছে এসে, একবার পিছন ফিরে তাকায়, শেষ বারের মতো। এই অবলম্বনে সে মাত্র
তিনটি দিনের বাসিন্দা ছিল। এই তিন দিনে এখানকার লোক গুলকে সে ভালবেসে ফেলেছিল। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, এগিয়ে যায় গাড়ীটার দিকে, কিন্তু না, থমকে দাঁড়িয়ে পরে। নাগাড়ী নেবে না, সে তো আর এখানে ফিরবে না। তাহলে গাড়নিয়ে কি হবে? থাক ওটা এদের কাজে লাগবে।
অয়ন একটু এগিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে বাজারে ফুলের দোকানে যায়।দোকানে ছেলেটাকে দিয়ে একরাশ গোলাপের তোড়াটা অবলম্বনে পাঠিয়ে দেয়। সঙ্গে এক  লাইনের জন্ম দিনের শুভেচ্ছা, আর একটি দুই লাইনের চিঠি।
ফুলের দোকানের ছেলেটি চলে যেতেই, সেও, একটা ট্যাক্সি নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
এদিকে অবলম্বনে সবাই কেক সাজিয়ে বসে আছে। অয়ন এলেই কেক কাটা হবে। কিন্তু অয়নের পাত্তা নেই, প্রায় সাড়ে ছটা বাজে তখন ফুলের তোরা নিয়ে ছেলেটি  অবলম্বনে আসে। সে স্বর্ণলতাকে চিঠি আর ফুলের তোরাটা দেয়। স্বর্ণলতা ছেলেটিকে জিঙ্গাসা করে
-- যে বাবু এগুলো তোমায় দিল? তিনি কোথায়?
-- জানিনা তো?
-- মানে? তুমি জান না?
-- না, আমাকে উনি এগুলো এখানে পৌঁছে দিতে বললেন, আমি নিয়ে এলাম।
-- ঠিক আছে তুমি যাও।
স্বর্ণলতা ফুলের তোড়াটা টেবিলে রেখে, চিঠিটা খুলে পড়ে, চেঁচিয়ে ওঠে এই দ্যাখো এ খানে কী লিখেছে।
নির্মলা স্বর্ণলতার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে জোরে পড়ে যাতে সবাই শুনতে পায়, তাতে লেখা --
আমার ঘরের টেবিলে, ফুলদানীর নিচে চাপা দেওয়া, তোমাকে লেখা চিঠিটা  পড়লেই সব জানতে পারবে, --
সবাই তাড়াতাড়ি ওপরে অয়নের ঘরে যায়, ফুলদানির নিচ থেকে কাঁপা হাতে চিঠি নিয়ে স্বর্ণলতা, পড়ে, সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, চিঠি তে অয়ন লিখেছে---

প্রিয় বান্ধবী
স্বর্ণলতা”-- 
               তোমাকে কী নামে সম্বোধন করবো জানি না, এর আগে কোনো দিন তোমাকে চিঠি লিখি নি, তাই কী ভাবে লিখব বুঝতে পারছি না। এই ৬৬ বছর বয়সে তো আর প্রেমিক হয়ে, “প্রিয়তমালিখতে পারিনা। আর লেখাটা কী ঠিক হবেতাই প্রিয় বান্ধবীবলেই লিখলাম।  যাক যে কারণে এই চিঠি লেখা, সেটাই বলি,-- আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি, আর কোনো দিন আমাদের দেখা হবে না। কারণ, আমাদের বিয়ে।
আজ সকালে তুমি যখন বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে, আমি বেশ অবাক হয়ে  ছিলাম। তুমি বলবে, আমিও তো রাজি হয়েছিলাম তাই না? হ্যাঁ, আমি রাজি হয়েছিলাম।  তখনকার মতো আমি এই আলোচনা বন্ধ করার জন্য রাজি হয়েছিলাম। আমি চাইনি এই অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা আর হোক। এবার বলি কেন আমি বিয়েতে রাজি নই। আমি রাজি নই কারণ, তোমার ছেলে। আমি অনেক ভেবেছি, কিন্তু একটা কথা ভেবে, আমি কিছুতেই স্থির থাকতে পারছি না। যদি কোনো দিন তোমার ছেলে  বা তোমার বৌমা, যদি তোমাকে বলে, যে –“মা তার পুরনো প্রেমিককে বিয়ে করে বেশ সুখেই আছেন। এই বুড়ি বয়সে বিয়ে করে এক বিছানায় শোয়”-- সে যে, সব থেকে অপমানের হবে তোমার আমার পক্ষে। তোমার অপমান আমি কি করে সহ্য করবো? আমি জেনে বুঝে তোমার এই অপমান হতে দিতে পারি না। কারণ আমি যে তোমাকে ভালোবাসি। এই দ্যাখো, যা আমি তোমাকে কোনো দিন বলিনি আজ লিখে ফেললাম- আমি তোমায় ভালোবাসিযাক তোমার অপমান মানে আমার অপমান। আর কোনো মা তার সন্তানের কাছ থেকে এই ধরনের কথা যদি শোনে, সে যে কত বড় আঘাত হবে, আমি কল্পনা করতে পারি। তাই আমার এই সিদ্ধান্ত। আমি চেয়ে ছিলাম এই বয়সে এই বৃদ্ধাশ্রমে দুজনে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। আমি  যখন শুনলাম, তুমি এখানে আসছ, খুব, খুব খুশি হয়েছিলাম। আমি তো এসেছিলাম, আমার বাকি জীবনটা এই বৃদ্ধা-বৃদ্ধদের মাঝে কাটিয়ে দেব বলে। আমার যা টাকা  পয়সা আছে, তাই দিয়ে এদের একটু সুখ, একটু আনন্দ যদি দিতে পারি। কি হবে আমার টাকা পয়সা? আমি মরে গেলে সব টাকা পয়সার কি হবে? তাই আমি তোমার নামে ৭ কোটি, আর নির্মলার নামে ৫ কোটি টাকার চেক রেখে গেলাম। তুমি তোমার ইচ্ছে মতো খরচ করো। তুমি অমল বাবুকে বলেছিলে তোমার ছেলে টাকা না পাঠালে তোমাকে ভিক্ষা করতে হবেসেটাও আমি মেনে নিতে পারিনি। তাই তোমাকে এই টাকা দিয়ে গেলাম, আমার ইচ্ছা, তুমি তোমার ছেলের কাছ থেকে কোনো টাকা নিও না। আর নির্মলাকে বোলো, ওকে আমি বোন বলেছি। ও যেন আমার দেওয়া টাকা দিয়ে আমার শেষ ইচ্ছাটা পুড়ন করে। এই বৃদ্ধা-বৃদ্ধদের যেন একটু সুখে রাখে। আর কি? আমার এখনও ৫-৬ কোটি রইল, তা দিয়ে আমার এই   একার জীবনটা দিব্বি কেটে যাবে। একদিন তুমি আমায় বলেছিলে – “তুমি আর এসো না অয়ন”, আজ আমি তোমায় বলি -- তুমি আর ডেকো না স্বর্ণজানি না, কোথায় যাবো, হয়তো অন্য কোথাও অন্য কোনো আর এক অবলম্বনেসেখানকার বৃদ্ধা-বৃদ্ধদের সাথে কেটে যাবে বাকি জীবনটা। আবার বলি আমি তোমায় ভালবাসি-
ভালবাসা নিও----
                             তোমার অয়ন
 স্বর্ণলতা ধপ করে বসে পরে, সোফায়। তার দুচোখ জলের ধারা। তার কান্না জড়ানো গলায় অস্ফুষ্ট স্বরে বলে –“ ফিরে এসো অয়ন, ফিরে এসো আমায় ক্ষমা কর।  
 না, অয়ন আর ফিরে আসেনি, তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।   


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন