প্রথম বর্ষ, শারদ সংখ্যা, ১২ অক্টোবর' ২০১৫

রবিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৫

প্রবন্ধ






অরুণ চট্টোপাধ্যায়
                          বৈদ্যবাটী, হুগলী




শিশুর মন ও তার চাহিদা
       এটা ঈশ্বরের আশীর্বাদ কি অভিশাপ জানিনা তবে, আমরা বেশীর ভাগ মানুষ আমাদের ছেলেবেলার বেশীর ভাগ কথা ভুলে যাই ভুলে যাই আমাদের ছেলেবেলার সেই দিনগুলির সুখ, দুঃখ, আনন্দ, হাসি কান্না বা আরও অন্য অনেক অনুভূতির কথা। ভুলে যাই আমাদের চাহিদাগুলিভুলে যাই আমাদের স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন কিংবা আশা-আকাংখার কথাআমাদের দৈনন্দিন চাওয়া পাওয়া বা বেদনা যন্ত্রণার কথা
       তবে কেন জানি না এগুলো হয়ত মনে থাকলেই ভাল হততাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সুখ-দুঃখ, বেদনা-যন্ত্রণা আর স্বপ্নগুলোর কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন পরিণতি হত নাআমরা অনেকেই হয়ত ভুলে যাই একটা মন বুঝতে অনুরূপ আর একটা মন দরকার একটা শিশুমনকে বুঝতে দরকার আর একটা শিশুমনকৈশোর, তারুণ্য এ সবকে উপলব্ধি করার জন্য দরকার আর একটা কিশোর কিংবা তরুণ মন আমাদের যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব বা বার্ধক্য দিয়ে এদের বিচার আমরা করতে চাইআর ফলতই সে বিচার-বিবেচনায় থেকে যায় একগুচ্ছ ভুল শিশুমনগুলি পরিণতির পথে সঠিক দিশা পায় না । পায় না সঠিক বন্ধুত্বআমরা অনেকেই তাদের দেখি অভিভাবকসুলভ দৃষ্টিভঙ্গিতে । আমাদের দৃষ্টিতে স্নেহের ভাগ থাকে কম আর শাসনের ভাগ থাকে বেশীফলে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এই শিশুমনগুলি কারোর কারোর দৃষ্টিতে আবার স্নেহের ভাগ থাকে বেশী আর শাসনের ভাগ থাকে খুব কম ফলশ্রুতিতে শাসনের বাঁধন ঢিলে হতে হতে দড়িটাই বেরিয়ে যায় আমাদের হাতের মুঠো থেকে শিশুরা চলে যায় বিপথে ।
          স্নেহ আর শাসনের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখাটাই হল বড় কথা । আর তার জন্যে দরকার যিনি শাসন করবেন তিনি মনের দিক থেকে কতটা মিশে যেতে পারছেন শিশুর সঙ্গে। তাদের চাওয়া পাওয়ার সঙ্গে পরিচিত হতে না পারলে তাদের আমরা দেবই বা কি ভাবে ? তাদের সঙ্গে যথেষ্ট মাত্রায় সখ্য যদি না গড়ে তুলতে পারি তো তাদের শাসনের অধিকার আমরা পাব কি করে ? কথায় বলে, শাসন করা তাকেই মানায় সোহাগ করে যে । শাসনের সঙ্গে সোহাগের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক আমরা অস্বীকার করতে পারি কি ?
           শিশুরা যা চায় সেটা দেওয়াই কি তবে আমাদের কর্তব্য ? শিশুদের অপরিণত মন অনেক কিছুই চাইতে পারে । তারা এমন কিছু চাইতে পারে যেটা তাদের বর্তমান বা ভবিষ্যতের পক্ষে ক্ষতিকর । শিশুরা আবার বারণ শুনতে অভ্যস্ত নয় । তাতে তাদের জেদ বেড়ে যায় । যেটা বারণ করা হয় সেটাই বেশি করে করা তাদের ধর্ম। তারা সর্বদা পজিটিভ চায় । নেগেটিভকে পছন্দ করে না । কিন্তু নেগেটিভকে আর একটি নেগেটিভ দিলে তা পজিটিভ হয়ে যায়। ধরুন এই নেগেটিভ হল বড়দের বারণ আর পজিটিভ হল যেটা ছোটরা করতে চায় । তাই কোনও কাজ আমরা সরাসরি বারণ না করে যদি খারাপ কাজের সম্ভাব্য ফলাফল আগাম জানাবার চেষ্টা করতে পারি তো তারা হয়ত আমাদের বারণ মানতে পারে। এমন কি এটাকে তারা আমাদের বারণ হিসেবে নয়, তাদের নিজেদের পালনীয় কাজ হিসেবেই মনে করে অর্থাৎ এই বারণ শোনাটা । এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলার ইচ্ছা থাকলেও এই পরিসরে তা হয়ত সম্ভব নয় ।
       আজকের দুনিয়ায় “শৈশব” শব্দটা কেমন যেন সংক্ষিপ্ত হতে হতে বাদ যেতে বসেছে আমাদের জীবনের অভিধান থেকে শৈশব, কৈশোর বা তারুণ্যকে এমনভাবে একটা চাপের মধ্যে বেঁধে ফেলা হয়েছে যে সে হাঁসফাঁস করছে ফলে তার মন যে ক্রমেই বিদ্রোহী হয়ে উঠছে এ খবর আমরা রাখি না বা রাখতে চাই না কারণ শিশুজগৎ বলে যে আর একটা জগৎ আছে এটার বিশ্বাস আমাদের ক্রমশ কমে আসছে। তাই এখন শিশুদের জন্যে নতুন কোনও জগৎ আর তৈরি করা না গেলেও তাদের জন্যে যেটুকু আছে তাকেই রক্ষা করা উচিত ।
          বাড়ছে শিশুদের বা কিশোরদের বা তরুণদের হতাশা যারা মুক্ত আকাশ চায় তারা পায় একটা বদ্ধ খাঁচা এই শিশুগুলি বড় তাড়াতাড়ি “বড়” হয়ে যায়কারবাইডে পাকানো ফলের মত দরকচা হয়ে যায় তারাহয়ত এতে ফলব্যবসায়ীদের লাভ বেশী হয় বা লোকসান কম হয় কিন্তু ভোক্তাদের অপুষ্টি থেকেই যায়আত্মহত্যার প্রবণতা, বিপথগামিতা, অপ্রাপ্তবয়স্ক অপরাধ সমাজে কিন্তু বেড়েই চলে এজন্য আমরা হয়ত তাদের দোষ দিয়ে নিজেরা একটু নিজেদের দোষস্খালন করে শান্তিতে থাকতে চাই কিন্তু ভূবনের সেই গল্পটা মনে করুন তো ফাঁসির আগে মাসির কান কেটে নেবার গল্পটা ? সেই যে ঈশ্বরচন্দ্রের প্রথম ভাগে পড়েছিলেন  ? মনে পড়ছে না? হতেই পারেওগুলো আমরা যে সেই কোন ছেলেবেলায় পড়েছিলাম আজ হয়ত আর কেউ পড়ে না  
       শিশুদের জন্যে আমাদের চিন্তা কোন কোন দিকে থাকা উচিত ? তাদের গঠন –শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সব দিকটাই আমাদের নজরে রাখতে হবে । শিশুদের যে বিনোদন বলে একটা জিনিস থাকা দরকার সেটা যেন আমরা ভুলে যাই। আগেকার শিশুরা নিজেদের বিনোদন নিজেরাই খুঁজে নিত । মাঠে নানান খেলাধুলো বা ঘুড়ি ওড়ানো, পুকুরে সাঁতার কাটা বা অন্যান্য অনেক কিছু তারা পেত। আজকে খেলার মাঠ বা সাঁতারের উপযুক্ত পুকুরের হয়েছে যথেষ্ট সংকোচন খেলার  মাঠ তো দূরের কথা গৃহস্থের বাড়ি করার জমি পর্যন্ত অমিল প্রোমোটারের থাবা থেকে একটু বড় জমিকে বাঁচিয়ে রাখা সত্যি বড় কষ্টের। কোলকাতা বা তার সংলগ্ন বড় শহরগুলিতে তবু কিছু কিছু পার্ক হয়েছে বা হচ্ছে কিন্তু গ্রাম বা মফঃস্বলের ক্ষেত্রে এখনও তা স্বপ্নের নামান্তর ।   
           ভেবে দেখুন তো আজ শিশুদের উপযুক্ত সাহিত্য বা চলচ্চিত্র কতটা বিস্তার লাভ করেছে? অথচ সবাই স্বীকার করবেন মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করার জন্যে এই দুটি অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম । এই দুটির সাহায্যে বিনোদনের মাধ্যমে কত সহজে শিক্ষা দেওয়া যায়। একটা পড়ার বই বা পাঠ্যপুস্তক থেকে শিশুরা যা শেখে তার চেয়ে অনেক বেশি শেখে একটা গল্পের বই থেকে । এর কারণ পাঠ্যপুস্তক তারা বাধ্য হয়ে পড়ে পাশ করার জন্যে আর গল্পের বই তারা পড়ে স্বেচ্ছায় মন ভরাবার জন্যে। তাই পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি সমগোত্রীয় উপযুক্ত গল্পের বই পড়াকে উৎসাহ দান তাদের শিক্ষাকে অনেক অনেক বেশি সফল করতে পারে ।
             শিশুশ্রম একটি সামাজিক অভিশাপ এ ব্যাপারে কোনও দ্বিমত থাকতে পারে না । একথা ঠিক যে শিশুশ্রমের অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে কিছু যেমন যুক্তিহীন তেমনি আবার কিছু যুক্তিগ্রাহ্যও বটে। আমাদের মত দরিদ্র ও মধ্যবিত্তপ্রধান দেশে খাটাবার মত শিশু খুব সহজেই পাওয়া যায় । শিশুদের কাজে লাগাবার বেশ কতগুলি কারণের মধ্যে হল শিশুগুলিকে যেমন খুশি পরিচালনা করা যায় । চায়ের দোকানেও লাগানো যায় আবার ড্রাগ পাচারের মত অপরাধমূলক কাজেও ব্যবহার করা যায় । শিশুদের বেশি কাজ করিয়ে অল্প পারিশ্রমিক দেওয়া যায় কারণ তাতে তারা প্রশ্ন তোলে না। তাদের এমন কোনও সগঠন নেই যাতে তারা সমাজকে নাড়িয়ে দিতে পারে ।
               এই সঙ্গে মনে রাখতে হবে এই সব শিশুদের বেশির ভাগ আসে কিন্তু দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের থেকে । এদের বাবা মায়েরা বা অভিভাবকেরা হয়ত সম্পূর্ণ উপার্জন অক্ষম অথবা শারীরিক দিক থেকে পঙ্গু । এই শিশুগুলিকে বাধ্য হয়ে কাজ করতে হয়। আর এটাও মনে রাখতে হবে সমস্ত শিশুশ্রমিক নিয়োজকরাই অমানুষ নয় । এইভাবে অনেকেই কত অসহায় পরিবারে স্রেফ শিশুদের মাধ্যমেই তারা অন্ন জোগাচ্ছে । কেবলমাত্র আইন করলেই হয় না বাস্তবটাকেও মাথায় রাখতে হয় ।
       কিশোরদের মধ্যে হতাশার অনেক কারণের একটি হল তাদের উপযুক্ত পড়াশোনাতে বাধা। ব্যক্তিগত পছন্দ অনুসারে পড়াশোনার সুযোগ তারা পায় না । আর্থিক, আর্থ-সামাজিক ও আরও অনেক বিষয় এর কারণ হতে পারে কিন্তু কথাটা হয়ত কেউ অস্বীকার করতে পারেন না সব শিশুই যে পড়াশোনা ভালবাসবে বা পড়াশোনা করবে এমন ভাবাটা কি ঠিক ? অনেক শিশু পড়াশোনাকে বালাই বলে ভাবলেও হাতে-কলমে কাজে খুব উৎসাহী । তাদের তেমন কাজেই লাগানো দরকার। এ কাজেই তাদের বিনোদন 
         আজ সবাই স্বীকার করেন মানুষ একটি সম্পদ। কারণ ‘মানুষ মানুষেরই জন্যে’। শিশুরাও মানুষ তারাও সম্পদ। তারা দেশের ভাবি নাগরিক এটা ভেবে অনেকে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেন তাদের বড় হবার অপেক্ষায় । কিন্তু মনে রাখা দরকার একটি শিশু কেবল শিশু হিসেবেই সম্পদ হতে পারে যদি তাদের বর্তমানটাকেই কাজে লাগানো যায় । একটি সমাজ সব প্রকারের সব বয়সের মানুষ নিয়েই গঠিত। একটি নারকেল গাছের যেমন শেকড় থেকে পাতা পর্যন্ত কিছুই ফেলা যায় না সমাজে মানুষের কিন্তু অবস্থান একই । তাই শিশুর কথা ভাবুন। আর ভাবুন শিশুর মত উন্মুক্ত আর উদার মন নিয়ে । তাকে যেমন ভাবে যেদিকে ঘোরাবেন সে সেই দিকেই ঘুরবে। তাই বড়দের দায়িত্ব তাদের কিছুতেই খারাপ দিকে ঘুরতে দেওয়া যাবে না ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন