অরুণ চট্টোপাধ্যায় বৈদ্যবাটি, হুগলী |
ভেকুবাবার ভেল্কি
আশ্চর্য ক্ষমতা নাকি
ভেকুবাবার। শুকনো বেলপাতা শুঁকিয়ে আর নকুলদানা খাইয়ে নাকি সব রোগ ভাল করে দিতে
পারে । ভিড় লেগেই আছে ।
ছোট বড় মেজ নানা আকার আর প্রকারের রোগি । চিকিৎসা শাস্ত্রে আজ কত রকমের শাখা আর
প্রশাখা । কত রকমের ওষুধ আর কত রকমের চিকিৎসা । কিন্তু তবু মানুষের রোগ কি যায় ছাই।
অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি, ইউনানি এসব তো আছেই। তাছাড়া আছে জড়িবুটি,
ঝাড়ফুঁক, মন্ত্রতন্ত্র, ম্যাগ্নেটোথেরাপী, ইলেক্ট্রোথেরাপী, আকুপাংচার এসব নানান
থেরাপী। রোগ কিন্তু দিনে দিনে রক্তবীজের মত বেড়েই উঠছে আর বেড়েই উঠছে। মানুষ আর
পেরে উঠছে না।
এমন সংকট সময়ে ভেকুবাবার
আবির্ভাব লোকের বিশেষভাবে রোগিদের মধ্যে স্বস্তি আনবে সেটাই স্বাভাবিক। বিশেষ আরও
এই কারণে যে অন্যান্য “বাবাদের” মত লোভী নন আমাদের ভেকুবাবা। নিজস্ব কোনও দাবী
নেই। যে যা দেয় তাই নেন তিনি। তাও নিজে হাতে নেন না। চাল ডাল কলা মুলো যে যা দেয়
তা তাঁর সামনে একটা বেদিতে রেখে দেওয়া হয়। কেউ কেউ যে নগদ টাকা দেয় না তাও নয়। তবে
সবাই বেশ কিছু দেয়। আসলে বাবার ছোঁয়ায় রোগগুলো সেরে তো যায় নাকি। চক্ষুলজ্জা বলে
কি কিছুই থাকবে না?
ধ্যানের মধ্যে দিয়েই রোগীকে
দেখেন তিনি। অবশ্য ডাক্তারের মত রোগলক্ষন নিয়ে প্রশ্নও করেন। তারপর নাম আর গোত্র
একটা কাগজে লিখে সেবায়েতদের কাছে দেন। সেবায়েতরা ভেতরের একটা ঘর থেকে রোগির জন্য
নিয়ে আসে নকুলদানা আর শুকনো বেলপাতা। ভেকুবাবা সেগুলো মন্ত্রপুত করে দেন।
এক নাছোড়বান্দা সাংবাদিক বলল,
এ সব বুজরুকি। শুকনো বেলপাতা আর নকুলদানায় সব রোগ সারলে ডাক্তারদের কি দরকার।
সাংবাদিক তো চুপি চুপি স্পাই
ক্যামেরা হাতে নিয়ে স্টিং অপারেশনে চলে গেল। ও ঘরে বাবা বসে রুগি দেখছেন আর এ ঘরে
বিরাট বারকোশে রাখা নকুলদানা আর শুকনো বেলপাতা রেডি হচ্ছে বাবার মন্ত্রপুত করে
দেবার অপেক্ষায়।
হঠাৎ চোখ চলে গেল একটা বড় ওষুধের
বাক্সর দিকে। সেবায়েতরা বাবার পাঠানো নামগোত্রের কাগজটা পড়ছে আর নকুলদানায় তরল
ওষুধ ঠেকিয়ে প্যাকেটে দিয়ে দিচ্ছে। নামগোত্র লেখা কাগজটা আসলে তবে ওষুধের
প্রেস্ক্রিপশন? সাংবাদিক তো মহাখুশি। রহস্য ফাঁস হয়ে যাবার আনন্দে। একটু পরে ভক্ত
রোগিদের সঙ্গে বাবার সাক্ষাতকার পর্ব শেষ হতে বাবা এ ঘরে এলেন। বেশ সবজান্তার ভাব
নিয়ে সাংবাদিক তো তাকে ধরল খপ করে। ভাবটা এবার তো ধরা পড়ে গেলে বাবাজী। কাহিনি খুব
বড় নয়। খুব সামান্য। বাবা তখন বাবা ছিল
না। ছিল সামান্য সনাতন ঘোষ। একটা ডাক্তারি
পাশ করে ভাবলেন লোকের সেবা করতে হবে। খুবই অল্প টাকায় ডাক্তার ওষুধ সব একেবারে
হাতের মুঠোয়। নিষ্ঠা ছিল লোকের ভাল করার। চেষ্টা ছিল। দিনরাত রুগীর কথা ভাবত। বড়
বড় বই পড়ত। সবাইকে প্রাণপণে বিশ্বাস করাবার চেষ্টা করত অল্প পয়সা হলেও তার
ডাক্তারি ভাল।
কিন্তু রুগি নেই পরিবর্তে
শুধু ব্যঙ্গ আর বিদ্রূপ। লোকে বলে এত অল্প টাকায় রোগ সারলে আর অত দামি দামি ওষুধের
দরকার কি ছিল? যত সব ভন্ডামি। লোকটা ডাক্তার নয় হাতুড়ে।
- কত ভাল এই শাস্ত্রটা জানেন?
কত জটিল রোগ সেরে যায় যেন এক মন্ত্রে। কিন্তু-
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল
সনাতনের বুক থেকে, অথচ একটা রুগী পেতাম না। কেউ বিশ্বাস করত না। ব্যঙ্গ করে বলত
হাতিঘোড়া গেল তল সনাতন ডাক্তার বলে কত জল।
সেইদিনটা বাঁধিয়ে রেখেছিল সে
নিজের মনের মধ্যে। যেদিন গিয়েছিল একটা তান্ত্রিকের পায়ে পড়তে।
- বেশি নয় মাত্র হাজার এক
টাকা প্রণামি বাবার, এক বন্ধু বলেছিল, একটিবার গিয়ে দেখ না। কিচ্ছু করতে হবে না।
বাবা তোর কপালে একবার ছুঁয়ে দিলেই দেখবি রুগী আসছে হুড়মুড়িয়ে।
গিয়েছিল আর দেখেছিল সেই
বাবাজীর কেরামতি। স্রেফ সম্মোহন বিদ্যের ওপর ভর করেই লাখ লাখ টাকা কামিয়ে যাচ্ছে।
বুঝেছিল ওটা আসলে ভন্ড। কিন্তু কৌশলটা মাথায় এসে গেল। মানুষ সততাকে যত না বিশাস
করে তার থেকে বেশি বিশ্বাস করে ভন্ডামিকে। আর কি -- ডাঃ
সনাতন হয়ে গেল ভেকুবাবা ।
- বুঝলাম মানুষ সোজা সরল কথা
বিশ্বাস করে না। ভেক ছাড়া মিলবে না ভিখও । তাই-
তাই সেদিনের সনাতন ডাক্তার
হয়েছে আজকের ভেকুবাবা । লোভ তার সেদিনও ছিল না আজও নেই। হ্যাঁ লোভ একটা নেই যে তা
নয়। সহজে জটিল রোগ সারানোর লোভ।
স্পাই ক্যামেরা পকেটে ঢুকিয়ে
রাখল সাংবাদিক । স্টিং অপারেশন সফল কিন্তু এর রিপোর্ট বার করার কোনও ইচ্ছেই তার নেই
আর। কিছু গোপন জিনিস গোপন থাকাই ভাল ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন