প্রথম বর্ষ, শারদ সংখ্যা, ১২ অক্টোবর' ২০১৫

সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৫

ছোট গল্প

                                                                                         বন্দনা রায়
                                                                                                                                        কোলকাতা

      ঠাকুমার জন্যে
          ঠাকুমা মারা গেছেন । বমি করতে করতে বিছানা থেকে ধপ করে পড়ে গেলেন । মায়ের পিছন ফেরা শরীরের আড়াল থেকে ঠাকুমার মুখ খানা দেখা যাচ্ছিল । চোখে পিচুটিজল, ঠোট বেঁকে আছে, থুতনি কাঁপছে ঠকঠক করে । মেঝে থেকে মায়ের দিকে মুখ তুলে অদ্ভুত কাতর গলায় বললেন, ‘ বৌমা... বাঁচাও...।মা ধমক দিলেন চোপ’!
        সিঁড়ির অন্ধকার থেকে ঠাকুমার ঘরে উঁকি দিচ্ছিলাম । হটাৎ এই দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে ঠাকুমা জবাইয়ের ছাগলের মতো ডাকলেন, ‘মানিক...
        মা বিদ্যুৎ বেগে ফিরলেন । মায়ের নড়াচড়ায় জানলার আলো উলোট পালোট হল । হিম হয়ে গেলাম মায়ের দৃষ্টিতে । মা বললেন, ‘নেমে যা, নইলে মেরে ফেলব ।দৌড়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে কোমরে লাগল । কোন মতে নিচে এসে ঠকঠকিয়ে কাঁপতে লাগলাম । মা কি ঠাকুমা কে মেরে ফেলছেন ?
        বাবা পরশু মালদায় গেছেন । আজ সকালে ফেরার কথা এখনও ফেরেননি । যাবার আগের দিন গভীর রাতে হটাৎ ঘুম ভেঙে বাবা মায়ের ঝগড়ার কিছুটা শুনে ফেলেছিলাম । বাবা চাপা গলায় মাকে বলছিলেন,’ মাকে না খাইয়ে মারতে চাইছ শেফালি ? টাকা আর বাড়ির জন্যে ? এ তো আমরাই ভোগ করছি, তবু কেন ? মাকে তুমি এভাবে--!
        বাবার কথার উপর মা ঝাঁপিয়ে পড়লেন,’ ও ! এর মধ্যেই লাগিয়েছে কানে । নিজে তো অফিসের নামে লুচ্চামি করে বেরাচ্ছো । ঘাড়ে ওই ঘাটের মরা বুড়ি, বাজারহাট, বাচ্চা মানুষ, প্রাণ বেড়িয়ে গেল আমার ।টাকা ফেলে রক্ষিতা রেখেছ আমাকে ? মালদায় যাকে নিয়ে যাচ্ছ, মা মরলে তাকে সেখানেই রাখতে পারবে সেই ব্যবস্থাই করছি ।
        বাবা আর্তনাদ করলেন, ‘ছি!গরগর করছিলেন মা, ‘ আমাকে ধমকাতে এসো না । কি দিয়েছো সারাজীবন ? শরীর , টাকা, গয়না, কোন সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছো আমাকে বলো ? নিজে তো মজা লুটছ, আমি চোর দায়ে ধরা পড়ে তোমার জেলে ঘানি ঘোরাচ্ছি পনেরো বছর । সব্বাই কে শেষ করে ফেলব আমি ।
        বাবা কোনোরকমে বললেন, ‘ মাকে তুমি প্রথম থেকেই সহ্য করনি, তার উপর মা-ই তোমাকে ধরে ফেলেছিলেন । তবে মাফও পেয়েছিলে আমাদের কাছে । কিন্তু আজকাল মাকে যা করছ মানুষ ভাবতে পারে না । আমায় পেটে ধরেছেন মানুষ  করেছেন, তোমারও কম করেননি তিনি । ধর্মসাক্ষী করে বলতো শেফালি, মা কি খুব খারাপ ? কেন মাকে খেতে দিচ্ছো না ?’
ও মাতৃভক্তি । ঠিক আছে, হাভাতে বুড়ীকে দেখাচ্ছি । অতো টান তো মালদা না গিয়ে মায়ের কাছে যাচ্ছ না কেন ?’ মা এই কথা বলতে না বলতেই ঠাস করে চড় মারলেন বাবা । সব চুপচাপ । হটাৎ মা বললেন, ‘এর জবাবে তুমি কেঁদে কুল পাবে না দেখো ।
         অনেকক্ষণ বাদে বাবা ভাঙা গলায় বললেন, ‘মাকে এইভাবে মেরোনা শেফালি , এখন আমিও তো মায়ের কাছে যাই না । কেন ওকে এমন করছ ? নিরঞ্জন কে তুমি ডেকে পাঠাও, বিয়ে করেছে তো কি হয়েছে, তুমি ডাকলে ঠিক আসবে । নিরঞ্জনের সাথে হাতে নাতে ধরা পড়বার প্র থেকেই তুমি নানা ভাবে শোধ নিয়ে চলেছ । তুমি তো ভালো করেই জানো, আমি লোচ্চা নই । তা ছাড়া মানিক কি তোমার পেটের ছেলে নয় ?
মা বিকৃত গলায় বললেন, ‘গোড়া কেটে আগায় জল দিতে এসো না, ন্যাকা কোথাকার ।
        এরপর আর কোন শব্দ হল না । আমার ভীষণ জল তেষ্টা পেয়েছিল । আমি জেগে আছি জানাতে ভয় পাচ্ছিলাম, পাছে মা বাবার লজ্জা বেড়ে যায় ।
        আজকাল সারাদিন কথাই বলেন না মা । আমার সঙ্গেও না ।  ঠাকুমার কাছে দোতলায় যেতেও দেন না । শান্তিরাণী মায়ের খুব বশ । চাইলেই খাবার আর পুরনো কাপড় পায় বলে । ও ঠাকুমার অন্যান্য কাজ করে দিয়ে চলে যায় । মা খাবার দিয়ে আসেন । আমি টিফিন বাঁচিয়ে ঠাকুমাকে লুকিয়ে খাইয়ে আসি । ঠাকুরদার মতো দেখতে বলে আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন ঠাকুমা । ঠাকুমা দেখতেও খুব সুন্দর । মাখন-রঙ, সাদা কাঁধছাটা কোঁকড়া চুল, টানাটানা নীল চোখ । পরীর মতো । মা-ও সুন্দর, তবে ঠাকুমার পাশে চোখেই পড়েন না । আমি ভাবতাম, এই জন্যই ঠাকুমাকে হিংসে করে মা । বাবাকেও সেইজন্য ঠাকুমার কাছে যেতে দেন না । ছেলেবেলায় বাড়ী নিয়েও খুব একটা ঝগড়া বেধেছিল, তখন ব্যাপারটা বুঝিনি । বড় হয়ে ভেবেছি হয়তো ঠাকুমার নামে বাড়ী বলে মায়ের রাগ ।
কিন্তু সেদিন রাতের ঝগড়া শোনার পর থেকে আমার আমার ভাবনায় সব কিছু তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে ।
সবাই এলে মা মা এত সুন্দর হয়ে ওঠেন যে, সবার কাছে মায়ের খুব সুখ্যাতি । অথচ ভেতরে ভেতরে মা এত রাগী ও একা, আমি ঠাকুমা আর বাবা ছাড়া কেউ জানে না ।
আচ্ছা, নিরঞ্জন কে ? কী ধরে ফেলেছিলেন ঠাকুমা ? কাল সকালে চা-বিস্কুট দিয়ে এসেছিল শান্তিরাণী । তারপর দুপুরে বা সারারাত ঠাকুমা কিছু খায়নি । বেশি বুড়ী হননি ঠাকুমা , তবু কোমরের দিকটা পড়ে গেছে । সিঁড়ি বেয়ে নামতে পারেন না । রাতে মা-ও যাননি । আমি আলু ভাজা আর মাছ ভাজা দিয়ে গরম ভাত খাচ্ছিলাম, ওপর থেকে ঠাকুমা ডাকছিলেন, ‘বৌমাও বৌমা, বড্ড খিদে পেয়েছে মা ।
আমার চোখ থেকে জল গড়িয়ে থুতনিতে ঝুলছিল । মা রুক্ষ চোখে তাকালেন । আমি বাঁ হাতের পাতার ওপর দিক দিয়ে জল মুছে ফেললাম ।
        রাত কাটল । সকাল নটাতে বাবার ফেরার কথা, ফেরেননি । বারোটা বাজল । ট্রেন কি দেরি করছে ? সকালে ময়দা, কলা, দুধ আর বাতাসা দিয়ে সিন্নি মেখে ঠাকুমা কে দিয়ে এলেন মা । অথচ এটা ঠাকুমার একাদশীর খাবার । আমারও ভাগ থাকে । আমি চাইলাম । মার চোখে আগুন ছুটল ।
        এগারোটা থেকে ঠাকুমার নাড়ী ছেঁড়া বমির শব্দ । আমার যাবার হুকুম নেই । মা ওপরে গেলেন । লুকিয়ে পিছু পিছু আমি । দেখলাম রক্ত বমি করছেন ঠাকুমা । মা আমাকে দেখতে পেয়ে ধমকে তাড়িয়ে দিলেন । আমি নিচে এসে কাঁপছি আর কাঁদছি । বাবা কেন এখনও ফিরছেন না ? কী করি আমি ? এই গাছপালা ঘেরা বাড়ী থেকে টুঁ শব্দ বাইরে বের হয় না । বাবা না ফিরলে ঠাকুমা যে মরে যাবেন ।
        গেটে শব্দ । কে ? বাবা ? বড় হয়েছি, সেটা ভুলে গিয়ে বাবার শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম । কেঁদে উঠে বললাম, ‘বাবা, ঠাকুমার সিন্নিতে বেগনবেট...। বমি করে মরে যাচ্ছেন ঠাকুমা বাঁচাও ।
        বাবার হাত থেকে ব্যাগটা খসে গেল । মুহুর্তখানেক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে, হটাৎ চঞ্চল হয়ে উঠে বললেন, ‘কাউকে ব্লিস না মানিক, দৌড়ে প্রণব কে ডেকে আন ।
        ডাক্তার কাকুকে নিয়ে ফিরে দেখি, অজ্ঞান ঠাকুমাকে কোলে করে নামাচ্ছেন বাবা । ঠাকুমার হাত আর ঘার ঝুলে রয়েছে । বাবার চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে ।  বাবা বললেন, ‘প্রণব, ফুড-পয়জন ।কাকু দ্রুত ব্যাগ খুলে ইনজেকশন বের করতে করতে বললেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স ডাক খোকন । মানিক জল আন ।
        বাব ছুটে বেড়িয়ে গেলেন । আমি জল এনে পাশে দাঁড়িয়ে আছি । এমন সময় ওদিকে পর্দার নীচে মায়ের শাড়ী দেখা গেল । সেদিকে মুখ তুলে, চাবুক মারার মত মাকে কয়েকটা কথা বললেন ডাক্তার কাকু । শুনে আমার বুকের শব্দ থেমে যেতে বসেছিল । ধারণাই ছিল না, মাকে কেউ এভাবে কিছু বলতে পারে ।
        ডাক্তার কাকু বললেন, ‘বৌদি, খোকন আমার প্রাণের বন্ধু, মাসিমা মায়েরও অধিক । ওরা কীরকম মানুষ আমি জানি । আপনার সব কথাও আমার জানা । কী হয়েছে, কেউ না বুঝুক, আমি বুঝেছি । মাসিমা কে ফেরাতে না পারলে আপনাকে আমি ছেড়ে দেব না, এটা জেনে রাখবেন । তবে ফেরাতে পারলে, আপনার প্রতি খোকনের ভালবাসার খাতিরে, শেষ সুযোগ আপনাকে দেব । নিজেকে একবার বদলে ফেলতে হবে আপনাকে ।
        ‘ঠাকুমা গো । তুমি ফিরে এসো গো । তুমি মোরো না গো ।আমি কেঁদে ফেললাম ।
        কার জন্যে ? মায়ের না ঠাকুমার

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন