বন্দনা রায় কোলকাতা |
ঠাকুমার
জন্যে
ঠাকুমা
মারা গেছেন । বমি করতে করতে বিছানা থেকে ধপ করে পড়ে গেলেন । মায়ের পিছন ফেরা
শরীরের আড়াল থেকে ঠাকুমার মুখ খানা দেখা যাচ্ছিল । চোখে পিচুটিজল,
ঠোট বেঁকে আছে, থুতনি কাঁপছে ঠকঠক করে । মেঝে
থেকে মায়ের দিকে মুখ তুলে অদ্ভুত কাতর গলায় বললেন, ‘ বৌমা...
বাঁচাও...।’ মা ধমক দিলেন ‘চোপ’!
সিঁড়ির অন্ধকার থেকে
ঠাকুমার ঘরে উঁকি দিচ্ছিলাম । হটাৎ এই দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে ঠাকুমা জবাইয়ের
ছাগলের মতো ডাকলেন, ‘মানিক...’ ।
মা বিদ্যুৎ বেগে ফিরলেন ।
মায়ের নড়াচড়ায় জানলার আলো উলোট পালোট হল । হিম হয়ে গেলাম মায়ের দৃষ্টিতে । মা বললেন,
‘নেমে যা, নইলে মেরে ফেলব ।’ দৌড়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে কোমরে লাগল । কোন মতে নিচে এসে ঠকঠকিয়ে কাঁপতে
লাগলাম । মা কি ঠাকুমা কে মেরে ফেলছেন ?
বাবা পরশু মালদায় গেছেন ।
আজ সকালে ফেরার কথা এখনও ফেরেননি । যাবার আগের দিন গভীর রাতে হটাৎ ঘুম ভেঙে বাবা
মায়ের ঝগড়ার কিছুটা শুনে ফেলেছিলাম । বাবা চাপা গলায় মাকে বলছিলেন,’ মাকে না খাইয়ে মারতে চাইছ শেফালি ? টাকা আর বাড়ির
জন্যে ? এ তো আমরাই ভোগ করছি, তবু কেন ?
মাকে তুমি এভাবে--!’
বাবার কথার উপর মা ঝাঁপিয়ে
পড়লেন,’ ও ! এর মধ্যেই লাগিয়েছে কানে । নিজে তো অফিসের নামে
লুচ্চামি করে বেরাচ্ছো । ঘাড়ে ওই ঘাটের মরা বুড়ি, বাজারহাট,
বাচ্চা মানুষ, প্রাণ বেড়িয়ে গেল আমার ।টাকা
ফেলে রক্ষিতা রেখেছ আমাকে ? মালদায় যাকে নিয়ে যাচ্ছ, মা মরলে তাকে সেখানেই রাখতে পারবে সেই ব্যবস্থাই করছি ।’
বাবা আর্তনাদ করলেন,
‘ছি!’ গরগর করছিলেন মা, ‘ আমাকে ধমকাতে এসো না । কি দিয়েছো সারাজীবন ? শরীর ,
টাকা, গয়না, কোন সুখ
স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছো আমাকে বলো ? নিজে তো মজা লুটছ, আমি চোর দায়ে ধরা পড়ে তোমার জেলে ঘানি ঘোরাচ্ছি পনেরো বছর । সব্বাই কে শেষ
করে ফেলব আমি ।’
বাবা কোনোরকমে বললেন,
‘ মাকে তুমি প্রথম থেকেই সহ্য করনি, তার উপর
মা-ই তোমাকে ধরে ফেলেছিলেন । তবে মাফও পেয়েছিলে আমাদের কাছে । কিন্তু আজকাল মাকে
যা করছ মানুষ ভাবতে পারে না । আমায় পেটে ধরেছেন মানুষ করেছেন, তোমারও কম করেননি
তিনি । ধর্মসাক্ষী করে বলতো শেফালি, মা কি খুব খারাপ ?
কেন মাকে খেতে দিচ্ছো না ?’
‘ও মাতৃভক্তি । ঠিক আছে, হাভাতে বুড়ীকে দেখাচ্ছি ।
অতো টান তো মালদা না গিয়ে মায়ের কাছে যাচ্ছ না কেন ?’ মা এই
কথা বলতে না বলতেই ঠাস করে চড় মারলেন বাবা । সব চুপচাপ । হটাৎ মা বললেন, ‘এর জবাবে তুমি কেঁদে কুল পাবে না – দেখো ।’
অনেকক্ষণ বাদে বাবা ভাঙা গলায় বললেন, ‘মাকে এইভাবে মেরোনা শেফালি , এখন আমিও তো মায়ের কাছে
যাই না । কেন ওকে এমন করছ ? নিরঞ্জন কে তুমি ডেকে পাঠাও,
বিয়ে করেছে তো কি হয়েছে, তুমি ডাকলে ঠিক আসবে
। নিরঞ্জনের সাথে হাতে নাতে ধরা পড়বার প্র থেকেই তুমি নানা ভাবে শোধ নিয়ে চলেছ ।
তুমি তো ভালো করেই জানো, আমি লোচ্চা নই । তা ছাড়া মানিক কি
তোমার পেটের ছেলে নয় ?
মা
বিকৃত গলায় বললেন, ‘গোড়া কেটে আগায় জল
দিতে এসো না, ন্যাকা কোথাকার ।’
এরপর আর কোন শব্দ হল না ।
আমার ভীষণ জল তেষ্টা পেয়েছিল । আমি জেগে আছি জানাতে ভয় পাচ্ছিলাম, পাছে মা বাবার লজ্জা বেড়ে যায় ।
আজকাল সারাদিন কথাই বলেন না
মা । আমার সঙ্গেও না । ঠাকুমার কাছে
দোতলায় যেতেও দেন না । শান্তিরাণী মায়ের খুব বশ । চাইলেই খাবার আর পুরনো কাপড় পায়
বলে । ও ঠাকুমার অন্যান্য কাজ করে দিয়ে চলে যায় । মা খাবার দিয়ে আসেন । আমি টিফিন
বাঁচিয়ে ঠাকুমাকে লুকিয়ে খাইয়ে আসি । ঠাকুরদার মতো দেখতে বলে আমাকে প্রচণ্ড
ভালোবাসেন ঠাকুমা । ঠাকুমা দেখতেও খুব সুন্দর । মাখন-রঙ, সাদা
কাঁধছাটা কোঁকড়া চুল, টানাটানা নীল চোখ । পরীর মতো । মা-ও
সুন্দর, তবে ঠাকুমার পাশে চোখেই পড়েন না । আমি ভাবতাম,
এই জন্যই ঠাকুমাকে হিংসে করে মা । বাবাকেও সেইজন্য ঠাকুমার কাছে
যেতে দেন না । ছেলেবেলায় বাড়ী নিয়েও খুব একটা ঝগড়া বেধেছিল, তখন
ব্যাপারটা বুঝিনি । বড় হয়ে ভেবেছি হয়তো ঠাকুমার নামে বাড়ী বলে মায়ের রাগ ।
কিন্তু
সেদিন রাতের ঝগড়া শোনার পর থেকে আমার আমার ভাবনায় সব কিছু তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে ।
সবাই
এলে মা মা এত সুন্দর হয়ে ওঠেন যে, সবার কাছে মায়ের
খুব সুখ্যাতি । অথচ ভেতরে ভেতরে মা এত রাগী ও একা, আমি
ঠাকুমা আর বাবা ছাড়া কেউ জানে না ।
আচ্ছা,
নিরঞ্জন কে ? কী ধরে ফেলেছিলেন ঠাকুমা ?
কাল সকালে চা-বিস্কুট দিয়ে এসেছিল শান্তিরাণী । তারপর দুপুরে বা
সারারাত ঠাকুমা কিছু খায়নি । বেশি বুড়ী হননি ঠাকুমা , তবু
কোমরের দিকটা পড়ে গেছে । সিঁড়ি বেয়ে নামতে পারেন না । রাতে মা-ও যাননি । আমি আলু
ভাজা আর মাছ ভাজা দিয়ে গরম ভাত খাচ্ছিলাম, ওপর থেকে ঠাকুমা
ডাকছিলেন, ‘বৌমা—ও বৌমা, বড্ড খিদে পেয়েছে মা ।’
আমার
চোখ থেকে জল গড়িয়ে থুতনিতে ঝুলছিল । মা রুক্ষ চোখে তাকালেন । আমি বাঁ হাতের পাতার
ওপর দিক দিয়ে জল মুছে ফেললাম ।
রাত কাটল । সকাল ন’টাতে বাবার ফেরার কথা, ফেরেননি । বারোটা বাজল ।
ট্রেন কি দেরি করছে ? সকালে ময়দা, কলা,
দুধ আর বাতাসা দিয়ে সিন্নি মেখে ঠাকুমা কে দিয়ে এলেন মা । অথচ এটা
ঠাকুমার একাদশীর খাবার । আমারও ভাগ থাকে । আমি চাইলাম । মার চোখে আগুন ছুটল ।
এগারোটা থেকে ঠাকুমার নাড়ী
ছেঁড়া বমির শব্দ । আমার যাবার হুকুম নেই । মা ওপরে গেলেন । লুকিয়ে পিছু পিছু আমি ।
দেখলাম রক্ত বমি করছেন ঠাকুমা । মা আমাকে দেখতে পেয়ে ধমকে তাড়িয়ে দিলেন । আমি নিচে
এসে কাঁপছি আর কাঁদছি । বাবা কেন এখনও ফিরছেন না ? কী করি
আমি ? এই গাছপালা ঘেরা বাড়ী থেকে টুঁ শব্দ বাইরে বের হয় না ।
বাবা না ফিরলে ঠাকুমা যে মরে যাবেন ।
গেটে শব্দ । কে ? বাবা ? বড় হয়েছি, সেটা ভুলে
গিয়ে বাবার শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম । কেঁদে উঠে বললাম, ‘বাবা,
ঠাকুমার সিন্নিতে বেগনবেট...। বমি করে মরে যাচ্ছেন ঠাকুমা বাঁচাও ।’
বাবার হাত থেকে ব্যাগটা খসে
গেল । মুহুর্তখানেক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে, হটাৎ চঞ্চল
হয়ে উঠে বললেন, ‘কাউকে ব্লিস না মানিক, দৌড়ে প্রণব কে ডেকে আন ।’
ডাক্তার কাকুকে নিয়ে ফিরে
দেখি, অজ্ঞান ঠাকুমাকে কোলে করে নামাচ্ছেন বাবা । ঠাকুমার
হাত আর ঘার ঝুলে রয়েছে । বাবার চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে । বাবা বললেন, ‘প্রণব,
ফুড-পয়জন ।’ কাকু দ্রুত ব্যাগ খুলে ইনজেকশন
বের করতে করতে বললেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স ডাক খোকন । মানিক জল আন
।’
বাব ছুটে বেড়িয়ে গেলেন ।
আমি জল এনে পাশে দাঁড়িয়ে আছি । এমন সময় ওদিকে পর্দার নীচে মায়ের শাড়ী দেখা গেল ।
সেদিকে মুখ তুলে, চাবুক মারার মত মাকে কয়েকটা কথা বললেন
ডাক্তার কাকু । শুনে আমার বুকের শব্দ থেমে যেতে বসেছিল । ধারণাই ছিল না, মাকে কেউ এভাবে কিছু বলতে পারে ।
ডাক্তার কাকু বললেন,
‘বৌদি, খোকন আমার প্রাণের বন্ধু, মাসিমা মায়েরও অধিক । ওরা কীরকম মানুষ আমি জানি । আপনার সব কথাও আমার জানা
। কী হয়েছে, কেউ না বুঝুক, আমি বুঝেছি
। মাসিমা কে ফেরাতে না পারলে আপনাকে আমি ছেড়ে দেব না, এটা
জেনে রাখবেন । তবে ফেরাতে পারলে, আপনার প্রতি খোকনের
ভালবাসার খাতিরে, শেষ সুযোগ আপনাকে দেব । নিজেকে একবার বদলে
ফেলতে হবে আপনাকে ।’
‘ঠাকুমা গো । তুমি ফিরে এসো
গো । তুমি মোরো না গো ।’ আমি কেঁদে ফেললাম ।
কার জন্যে ? মায়ের না ঠাকুমার ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন