প্রথম বর্ষ, শারদ সংখ্যা, ১২ অক্টোবর' ২০১৫

শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৫

ছোট গল্প






দেবাশীষ দে
              রূপনারায়ণপুর, বর্ধমান


সভ্যতার আদীমতা
সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল দেখে আর্যাহি শেষ অবধি  মন্দারের মোবাইল-এ ফোন করল । প্রথমটায় রিং হয়ে গেল । মন্দার তুলল না দেখে সে আরও রেগে গেল । একমিনিটের মধ্যেই অবশ্য মন্দারের ফোন এল, ‘তুমি একটু একা যেতে পারবে কি ? অফিসে একটা কাজে আটকে গেছি, আর কাজটা আজকেই করতে হবে
প্রথমটায় কি বলবে আর্যাহি ভেবে পায় না । তার একার পক্ষে এখন যাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া সে নিজে জায়গাটা ঠিক করে চেনেও না । অচেনা জায়গায় জিজ্ঞেস করে করে যেতে তাঁর যথেষ্ট খারাপ লাগে । মন্দার কে ছাড়া সে এভাবে কোনদিনও যায়নি কোথাও ।
        কি হল বলো, পারবে যেতে ? আসলে এমন একটা ব্যাপার যে সত্যি কথাটা বলতেও পারছি না বস-কে । বললেই বলবে, কার, কি হয়েছে ? তখন আবার আর এক ঝামেলা । কি গো পারবে যেতে ? না পরের সপ্তাহে যাবে ? সেদিন না হয় ছুটি নিয়ে নেব, রিস্ক না নিয়ে। মন্দার ও প্রান্ত থেকে অপরাধীর মত স্বরে কথা কটা বলে ।
কি বলবে আর্যাহি । না একা সে যেতে পারবে না । একটা মানসিক চাপ তাঁর উপর এমনিতেই আছে । ভয় যে করছে না তাও নয় । মন্দার যেদিন অফিস থেকে ফিরে বলল, ‘নাম লিখিয়ে দিয়েছে’, সেদিন থেকেই একটা ভয় তাকে ভিতরে ভিতরে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে । মেয়ে সৌমীলী বা মন্দার কে সে সেটা বুঝতে দেয়নি, ওরা দুশ্চিন্তা করবে বলে । না না একা সে যেতে পারবে না ।   তবে কি পড়ার কোচিং থেকে মেয়ে কে ডেকে নিয়ে ওর সাথে চলে যাবে । ভেবে কিছু ঠিক করার আগেই মন্দার আবার ফোনে জিজ্ঞেস করল, ‘কি গো কি করবে বলো ? আমার খুব খারাপ লাগছে কিন্তু এখন অফিস থেকে বেরোনো সম্ভব নয় গো । একটু বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ । আমি না হয় বাড়ী ফেরার পথে পরের আবার নাম লিখিয়ে দিয়ে যাব
ঠিক আছে ওটা পরেও লেখানো যাবে, তুমি সাবধানে সোজা বাড়ী এসোবলেই ফোনটা রেখে দেয় আর্যাহি ।
বেডরুমে ঢুকে পোশাক বদলাতে থাকে। শাড়ী, ব্লাউজ খুলে নাইটিটা হাতে নিয়েই একবার আয়নার দিকে চোখ যায় তার । আয়নার কাছে গিয়ে সে অন্তর্বাস খুলে ফেলে । একরাশ ভাবনা কোথা থেকে যেন ভিড় করে মাথায় । কি হবে যদি সত্যি হয় ? মন্দার কি করবে ? মেনে নিতে পারবে তাকে ? মেনে নিলেও এত টাকা সে কোথা থেকে পাবে ? অজান্তেই হাত চলে যায় ডান স্তনের বৃন্তটায় । না এখন তো শুকনোই আছে । ছোট হয়ে ভিতরের দিকে ঢুকে যাওয়ারও লক্ষণ নেই । তবে কি সবটাই ভুলভাল ভাবছে তারা । চিন্তার মায়াজালে কতক্ষণ কেটে গেছে আর্যাহি খেয়াল করেনি । হুঁশ ফেরে কলিং বেলের শব্দে । এখন আবার কে এলো ? তাড়াতাড়ি নাইটিটা পড়ে নিয়ে সে দরজার কি হোলে চোখ রাখে ।
দরজার ওপারে  তার সতেরো বছরের মেয়ে সৌমীলী । দরজা খুলেই সে জিজ্ঞেস করে, ‘কি রে আজ এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিল স্যার’?
সৌমীলী তার কাঁধ থেকে সোফার উপড়ে ব্যাগটা নামিয়ে রেখে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় কটা বাজে । টা বাজে দেখেছ ? তাড়াতাড়ি কোথায় ছেড়েছে ? রোজকার মতই তো এলাম । তুমি কই করছিলে । লাইট জ্বালানি কেন ঘরের ? আর তুমি ড্রেস চেঞ্জ করোনি এখনও । যাবে না ? বাবা কোথায় ?’
আর্যাহি দরজা বন্ধ করে রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে, ‘আসতে পারেনি । অফিসে জরুরি কাজ পড়ে গেছে । পরের সপ্তাহে যাব। কথাটা বলেই আর্যাহি খেয়াল করে একটু আগেও সে কই করবে ঠিক করতে পারছিল না, কিন্তু মেয়েকে জবাব দিতে গিয়ে কী অনায়াসে নিজের অজান্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো, পরের সপ্তাহে যাবে সে । ভেবে চিনতে এটা ঠিক তো সে করেনি তবু মন বলে দিল মুখ কে দিয়ে । এটাই মনে হয় সংসারে মেয়েদের মানিয়ে চলা । মানিয়ে নেওয়ার জন্য আলাদা করে ভাবতে হয় না, কোন প্ল্যান করতে হয় না, মন নিজের থেকেই ঠিক করে দেয় ।
কিন্তু এত আগে থেকে ঠিক করা আজকের দিনটা মন্দার মিস করল কি করে ? এটা মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না আর্যাহি । কেন সে বস-কে বলতে পারল না, আজ একটু আগে বাড়ী যাবে সে । কোনদিনও তো আগে আসেনা মন্দার । এমন কি বিয়ের পরে পরেও সে অফিস থেকে সবার শেষেই বেরত । আর্যাহি কোনদিনও এসব নিয়ে অনুযোগ করেনি । কিন্তু আজকের দিনটা যে আলাদা ছিল । সমস্যার পাহাড় যখন চেপে বসতে চাইছে তাদের সংসারের উপর তখনও মন্দার অফিস থেকে আগে বেরতে পারল না কেন? ওর বস কী মানুষ নয় নাকি যে এই সমস্যার কথা বললে একটু আগে ছেড়ে দেবে না ওকে । এসব ভাবতে ভাবতে আর্যাহি মেয়ের টিফিন বানাচ্ছিল ।
মা বেশি দেরি করা কিন্তু ঠিক হবে না। আর্যাহি তাকিয়ে দেখে মেয়ে রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে । কোন উত্তর দেয় না সে। কী উত্তর দেবে । দেরি করা ঠিক নয় এটা তো প্রথমে মন্দার নিজেই বলেছিল । বরঞ্চ আর্যাহি নিজেই প্রথমে বলেছিল আর কয়েকদিন দেখে নেই আগে, কী হচ্ছে । মেয়েদের নানা কারণে নানা কিছু সমস্যা হয় শরীরের । আজ সেই মন্দারই সময় করে উঠতে পারল না ।
বাবা আসতে পারেনি তো পারেনি, তুমি আমায় বললে না কেন ? আগে বললে আমি পড়তে যেতাম না, ঠিক নিয়ে যেতাম তোমায়।  মেয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে । আর্যাহির এই স্পর্শগুলোতে সব কিছু উলোট পালট হয়ে যায় মাথার ভিতর । মেয়েটা বড় হয়েছে কিন্তু বাচ্চাদের মত এখনও মা-কে ছুঁয়েই সব কিছু ।
হ্যাঁরে তুই কী ঐ জায়গাটা চিনিস নাকি যে আমাকে নিয়ে যেতে পারতি ?’ মেয়ের হাতে খাবার দিয়ে জিজ্ঞেস করে আর্যাহি ।
চিনি না তো কি হয়েছে, জিজ্ঞেস করে করে চলে যেতাম ঠিক । তুমি তো থাকতে সাথে । তুমি সাথে থাকলে দারুণ সাহস আমার । ঠিক তোমায় দেখিয়ে নিয়ে আসতাম। মুখে খাবার ভরেই কথাগুলো বলে যায় সৌমীলী ।
ঠিক আছে পরের বার তোর বাবা মিস করলে তোর কাঁধে চেপেই যাব । এখন খেয়ে নে আগেআর্যাহি চলে যায় তার শোবার ঘরে । বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে মাথাটা রাখে জড়ো করা দুই হাতের মধ্যে । কেন মন্দার বলতে পারল না বস কে । তবে কি বিষয়টা আজও লোকে নোংরা কিছু বলেই ভাবে নাকি ? নাকি পুরুষেরা মেয়েদের এইসব কে ঘেন্না করে এখনও । মন্দার তো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে । পরিষ্কার করে দেয় । তার চোখে মুখে কোনদিনও তো এসবের আভাস দেখেনি আর্যাহি । তবে আজ কি এমন হল যে লুকিয়ে রাখতে চাইল সবার থেকে ।
আর্যাহির ভাবনার জাল আর কিছুতেই ছিঁড়তে চাইছিল না । ভাবনার থেকে যত সে উত্তর খুঁজছিল ততই সে ভাবনার নূতন নূতন জাল বুনে চলছিল যেন । সেই জালে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছিল সে । সম্বিত ফেরে মেয়ের ডাকে, ‘ মা বাবা এসেছে । তুমি ঘুমচ্ছো দেখে ডাকতে বারণ করল । আমি চা করে দিতে গেলাম কিন্তু চিনির কৌটো খালি তাই ডাকতেই হল তোমায়
আর্যাহি ধড়মড় করে উঠে বসে মেয়েকে বলে, ‘তুই যা, আমি চা করছি। চা করে মন্দার কে দিয়ে আর্যাহি নিজেও সেই সোফাতে বসেই চা খেতে খেতে টিভি দেখছিল ।
পরের সপ্তাহে ছুটি নিয়েছি । নামটাও আবার লিখিয়ে দিয়ে এসেছি । একদম এক নম্বরে আছে তোমার নাম। মন্দার নাম লেখা অ্যাপয়েন্টমেন্ট স্লিপটা আর্যাহির দিকে এগিয়ে  দেয় । কোন কথা বলে না আর্যাহি । রাতে খেয়ে দেয়ে, সব কাজ সেরে বিছানায় গিয়ে দেখে মন্দার ঘুমাচ্ছে অঘোরে । কি নিষ্পাপ লাগছে মুখটা । ঠিক যেন একটা শিশু ঘুমিয়ে আছে । কিছুদিন আগেও কাজ সেরে আর্যাহি শুতে এলেই মন্দার ঘুমের মধ্যেও টের পেত ঠিক । সরে এসে বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে আবার ঘুমিয়ে পড়ত । সারারাত আর্যাহি মন্দারের মাথা টেনে ধরে রাখত নিজের বুকের মধ্যে । কিন্তু আর্যাহির বুকে ব্যথা হওয়ার পর থেকে এখন মন্দার উলটো দিকে পাশ ফিরেই ঘুমায় সারারাত । একবারও ভুল করে তার বুকে মাথা গুঁজে দেয় না । আর্যাহি একদিন বলেছিল একথা । মন্দার শান্ত গলায় তার উত্তর দিয়েছিল, ‘একেই তোমার ব্যথা, তার উপর আমার মাথার ভারে আরও ব্যথা বাড়ুক নাকি । এটা একটা পাগলের মত কথা বললে। 
না আর্যাহি পাগল হয়নি শুধু মাঝে মাঝে মনটা কাঙালের মত মন্দারের মাথাটাকে খোঁজে । ঘুম হয়না তখন আর । মন্দার তুমি হয়ত ঠিকই বলেছ, ব্যথা জায়গায় কেউ আঘাত করে না । কিন্তু বুকের ব্যথার ভিতরেও যে আর একটা ব্যথার জায়গা থাকে, সেটা কি তুমি বোঝ ?
এরপর দিন পেরোয়, এক সপ্তাহ পরে মন্দার একদিন অফিস যায়না । ঠিক সময়ে আর্যাহি কে নিয়ে যায় । ফিরেও আসে বিরিয়ানির প্যাকেট হাতে । কেটে যায় আরও কয়েকটা দিন । আর্যাহির নানা টেস্ট করাতে বলেছে ডাক্তার । সব কিছু ঠিক ঠিক সময়ে করে মন্দার । কোনও গাফিলতি নেই । আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়েও পড়ে সে । আজ আর্যাহির সমস্ত মেডিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট আনতে যাবে সে ।
সকাল থেকেই একরাশ চিন্তা আর্যাহি কে ঘিরে ধরেছে । কিছুতেই কিছু ভাল লাগছিল না তার । মেয়েটারও আজ মন ভাল নেই । ও মা, ও মা করে যেই মেয়েটা সারাদিন তাকে বিরক্ত করে মারে সেও আজ একেবারে চুপ । নিজেই সকালে উঠেই বলেছে আজ স্কুলে যাবে না । আর্যাহি একবার কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মন্দার ইশারা করায় চুপ করে যায় । আর্যাহি অন্যান্য দিনের মতই যথারীতি ঘরের সমস্ত কাজ করতে থাকে । একটা আনচান আনচান ভাব তাকে ঘিরে থাকে সারাদিন । দুপুরে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবার চেষ্টাও করে কিন্তু ঘুম আসেনা তার । এত টাকা কোথা থেকে পাবে মন্দার ? যদি সত্যি হয় তবে কি হবে ? মন্দারের এমন বয়স হয়েছে ? মাত্র উনপঞ্চাশ বছর । যৌন চাহিদা থাকাটাই স্বাভাবিক । তার নিজেরও কী কম আছে নাকি ? কিন্তু এরপর সে কি করবে ? মন্দারই বা কি করবে ? এইসব নানা চিন্তাই তার মাথা ভার করে রাখে আজকাল ।
বিছানায় উঠে বসে আর্যাহি । কেমন একটা অস্থির অস্থির ভাব লাগছে । মনে মনে একটা তালিকা তৈরি করার চেষ্টা করে কার কার কাছে কত টাকা সাহায্য চাওয়া যেতে পারে । নানা ভাবনা নানা রূপ নিয়ে দুপুর গড়িয়ে বিকেলে এসে পড়ে । জানলায় আলো কমে আসে । সৌমীলী একবার তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেছে । বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করেনি একবারও । তাই আর্যাহি এখনও বিছানাতেই বসে থাকে । কলিং বেল বাজে এক সময় । মেয়ে দরজা খোলে । মন্দার সোফায় বসে জুতো খুলছিল ।
আর্যাহি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মন্দার বলে, ‘ম্যামোগ্রাফি পজিটিভ । আমি ডাক্তারের কাছেও গিয়েছিলাম । উনি রিপোর্ট দেখে বললেন, টাকা পয়সা রেডি করুন মিস্টার মন্দার, এটা অপারেশন করতে হবে
আর্যাহি বেড রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে সবটা শুনে আবার বিছানায় গিয়ে বসে পড়ে । পজিটিভ, অপারেশন, টাকাপয়সা, রেডি শব্দগুলো তার কানে বাজতে থাকে । স্তন ক্যান্সার । তার এত যত্ন করা বুকের কেন এই মারণ রোগ বাসা বাঁধল সেই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই । ডাক্তার বাবুও বলতে পারেন নি ।শুধু বাস্তব সত্যিটা এখন মন্দার বলল, তার স্তন ক্যান্সার হয়েছে । অপারেশন করতে হবে । কেমন লাগবে তাকে দেখতে তখন । মন্দার কি আর কখনো তাকাবে সেদিকে ? মাথা কাজ করে না আর আর্যাহির । 
 একা একা বসে বসে তালিকাটা আবার একবার ভাবার চেষ্টা করে সে । ইস্‌স তখন লিখে রাখলে ভাল করত । এখন যে মনে আসছে না নামগুলো । মন্দার অফিস থেকে কত লোন পাবে কে জানে ? একদিন জিজ্ঞেস করেছিল সে কিন্তু মন্দার বলেছিল, ‘ আগে রিপোর্ট আসুক তারপর দেখা যাবে । শুধু শুধু লোনের হিসেব করতে গেলে অফিসে নানা কৈফিয়তের  জবাব দিতে হবে । তারপর সব শুনে কে জানে কে কে কি কি ফিসফিস করবে আড়ালে আবডালে । অফিস কালচার তো বোঝো না । আগে রিপোর্ট দেখি তারপর না হয় একটা কিছু ভেবে চিন্তে বলা যাবে লোনের জন্য
আর্যাহি সেদিন থেকে আর কথা বাড়ায় নি । একটা জিনিস আজও সে বোঝেনি কেন মন্দার কাউকেই জানতে দিতে চায় না । এটা হাতে পায়ে গলায় হলেও কি বলতে আটকাতো তার । স্তন ক্যান্সার বলতে এত দ্বিধা কিসের পুরুষদের ?
মন্দার নিজেই দুকাপ চা করে নিয়ে এসে বসে বিছানায় আর্যাহির মুখোমুখি । একটু পরে বলে, ‘সব মিলিয়ে অ্যামাউন্টটা একটু হেভি হয়ে গেল । অফিস থেকে মনে হয় একের বেশী পাব না
আমি একটা লিস্ট করছিলাম দুপুরে । কার কার কাছে বলা যায় । টাকা তো চাওয়া যাবে না সরাসরি কিন্তু  শুনলে যদি কেউ নিজে থেকে বলে । দাদাকে বলব যা পারে দিতে। বৌদি শুনলে কি করবে কে জানে ? তবু একবার বলে দেখব। আর্যাহি খানিক সাত্বনা দিতে বলে যেন কথাগুলো ।
না কাউকেই যখন বলা হয়নি তখন আর পাঁচ কান করে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে যেখানে বললে শিওর পাওয়া যাবে সেখানেই বলা ভাল । দেখি কাল বলব। বলেই মন্দার ফাঁকা কাপ রাখতে উঠে গেল ।
কাকে বলবে? সেটা বলবে তো নাকি ?’ আর্যাহি বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করে ।
বস-কেই বলব । লোকটার অনেক টাকা । দিতে চাইলে এইটুকু টাকা কোন ব্যাপারই নয় ওনার কাছে । শুধু ভাবছি কি ভাববেন উনি ?’ মন্দার আবার ফিরে এসে আধ শোয়া হয়ে পড়ে বিছানায় ।
কি ভাববে মানে ? টাকা চাইছ বলে নাকি আমার স্তন ক্যান্সার হয়েছে বলে ?’ প্রশ্ন করে সটান তাকিয়ে থাকে আর্যাহি মন্দারের দিকে । মন্দার কোন উত্তর না দিয়ে এবার শুয়েই পড়ে চিত হয়ে ।
এরপর কয়েকদিন পেরিয়ে যায় । আর্যাহিকে নিয়ম করে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। সৌমীলী আগের মত মায়ের সাথে হুড়োহুড়ি করতে পারে না । শুধু জড়িয়ে ধরে থাকে মা-কে । রাতে মন্দার শুলেই ঘুলেই ঘুমিয়ে পড়ে এখন । শুধু জেগে থাকে আর্যাহি । তার স্তনের ব্যথার থেকেও স্তনের পিছনের কোন এক জায়গার ব্যথা নিয়ে ।
একদিন মন্দার আচমকাই বিকালে অফিস থেকে ফিরে এসে বলে, ‘ ঘরটা একটু গোজগাজ করে নাও তো, বস আসবে একটু পরেই । আর হ্যাঁ তুমি তো বানাতে পারবে না এই অবস্থায়, কি খাবার কিনে আনবো বলো তাড়াতাড়ি?’
প্রায় তিন ঘণ্টা পরে মন্দারের বস এলেন । সাথে আরেক সেমি বস । এসেই মন্দার-কে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘লাগলে বোলো । আগে তো ওনাকে সুস্থ করে তোল । অপারেশন কবে যেন বললে ?’
মন্দার প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বলে, ‘স্যার টাকাটার জন্যই ওয়েট করছিলাম । ডাক্তার বলেছে আমি রেডি হলেই উনি অপারেশন করে দেবেন
আচ্ছা মন্দার অপারেশন মানে কি স্তন কেটে বাদ দিয়ে দেবে ? একটা থাকবে একটা নেই । মানে ঠিক কি রকম হবে ব্যাপারটা সেটাই মজার তাই না । নারীত্বে স্তন নেই । হা হা হা, কি মিঃ বোস ব্যাপারটা চোখ বুজে দেখার চেষ্টা করে দেখ কেমন যেন একটা ফিলিংস আসছে মনে। মজার স্বরে মন্দারের বস কথাগুলো বলে গেল ।
এবার মিঃ বোস মানে সেমি বস বললেন, ‘মন্দার তার মানে তোমাকে তো এবার সন্ন্যাস নিতে হবে ভাই । তা তোমার বয়স কত হল
আরে যাই হোক ওর বয়স তোমার থেকে তো ছোট । তুমি যদি এখনও জমিয়ে ক্ষীর করে খাও তো ওর কি ইচ্ছে করবে না নাকি ?’ মন্দার কে বয়সের হিসাব না দিতে দিয়ে তার বস নিজেই সবটা বলে দিল । বেডরুমে বসে বসে এসব শুনতে শুনতে আর্যাহির কান লাল হয়ে উঠল । ঘরে মেয়ে আছে মন্দার কি সেটা ভুলে গেল ।
বস আর সেমি বস তাদের কুৎসিত মানসিকতার নানা পরিচয় অবলীলায় দিয়ে চলেছে আর মন্দার উলটো দিকের সোফায় বসে চুপ করে শুনে যাচ্ছে । আর বিরক্তির হাসি হাসছে দেখে আর্যাহির আরও রাগ হল । একবার সে বলবে না যে এটা অফিস নয় কারও বাড়ী । তাছাড়া রোগী নিজে এসব শুনতে পাচ্ছে । মন্দার তুমি বলতে না পারলেও আমাকে বলতেই হবে এবার । যে নারীত্বের জন্য তোমরা মরা কান্না কাঁদছো সেই নারীত্বের সন্মাণ আমি মেয়ে হয়ে এভাবে নষ্ট হতে দেব না ।    
মনে মনে ভেবে নিয়েই আর্যাহি বসার ঘরে প্রবেশ করে সোজা চোখে দু জনের দিকে তাকিয়ে ওদের কথার মাঝেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘ অনেক হয়েছে প্লিজ । এবার আপনারা চুপ করুন । আপনার টাকা আপনি ফিরিয়ে নিয়ে যান । এত অপমানের পর আমার আর অপারেশনের দরকার নেই । কি ভাবেন আপনারা মেয়েদের ? আপনার স্ত্রীর স্তন ক্যান্সার হলে তো মনে হয় আপনি আর একটা বিয়ে করে নেবেন । স্তন মেয়েদের স্বাভাবিক একটা প্রত্যঙ্গ, যেমন হাত পা মাথা । সেটা উচ্চারণ করলেই আপনাদের মত সভ্য সমাজে অসভ্যতা মনে হবে  কেন ? যেভাবে আপনারা বারবার স্তন শব্দটাকে ব্যঙ্গ করে বলছেন আমি আর সহ্য করতে পারছি না । প্লিজ আমার দরকার নেই কিছুর আপনারা আসুন। কথা কটা বলেই সে বেডরুমে চলে আসে ।
বসার ঘরের আর কোন শব্দ শুনতে পায় না সে । একটু পরে দরজা খোলার শব্দ হয়। দরজা বন্ধের শব্দ হয় । মন্দার দরজার ওপার থেকে বলে পরশু সকাল আটটায় বেরবো
বেড থেকে আর্যাহি কে ট্রলিতে করে নিয়ে যাচ্ছে । মন্দার আর সৌমীলী দাঁড়িয়ে আছে সেটা আর্যাহী দেখতে পেয়ে একবার ট্রলিটা থামাতে বলে ইশারায় মেয়েকে ডাকে । একবার ওর হাত নিয়ে নিজের স্তনে বুলিয়ে নেয় । বড় ভালবাসত মেয়েটা এখনও খেতে চাইত । ট্রলি এগিয়ে যায় ।
মন্দার সৌমীলী কে বসিয়ে বাইরে এসে সিগারেট ধরায় । কতদিন আর ? একদিন তো তাকে অফিস যেতেই হবে । আর্যাহি থাকুক আর না থাকুক মেয়ের জন্য তাকে অফিস যেতেই হবে । কি করবে বস সেদিন ? আর্যাহির করা অপমানের বদলা নেবে কি ভাবে ? আর্যাহি কে ছাড়া সে নিজেই বা থাকবে কি নিয়ে ? বাইরে একটা চায়ের দোকানে উনুনে কয়লা দিয়েছে । কালো ধোঁয়া হাওয়ার সাথে এঁকে বেঁকে এসে মন্দার কে ঘিরে ধরে । অঝোরে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে মন্দারের । সে শুধু বোঝে না উনুনের কালো ধোঁয়ার জন্য নাকি স্তন ক্যান্সারের ব্যথায় তার দুচোখ জলে ভরে গেল ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন