অরুণিমা চৌধুরী
ব্যারাকপুর, কোলকাতা
স্তন ক্যান্সার
আসুন বাঁচি, হাতে
হাত বেঁধে থাকি...
'ক্যান্সার' শব্দটি শুনলেই মনের কোণে
গুঁড়ি মেরে একটা ভয় ঢোকে । কিছু মানুষ মনে করেন “
ইগনোরেন্স ইজ দ্য ব্লিস । আমার তো হয়নি, হলে
দেখা যাবে ।” চোখ কান বুজে পাশ কাটিয়ে দিতে পারলেই হল ।
রক্ষণশীল মনোভাব,
অহেতুক ভয় ও অজ্ঞতা অনেক ক্ষেত্রেই জীবননাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায় । বিশেষত
বিষয়টি যখন স্তনের ক্যান্সার ।
অক্টোবর মাস আমেরিকান ক্যান্সার
গবেষণা কেন্দ্র দ্বারা ঘোষিত 'ব্রেস্ট ক্যান্সার
মাস' ।
'টাইমস অফ ইন্ডিয়া'
পত্রিকায় প্রকাশিত 'ম্যাক্স সুপার
স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল'এর একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে জানা গেছে
ভারতে, প্রতি আঠাশ জন মহিলার মধ্যে একজনের স্তন ক্যান্সারে
আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল । পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৬৫ -
৭০ % স্তন ক্যান্সার আক্রান্ত ভারতীয় মহিলার গড় বয়েস ৫০ এর উপরে । মাত্র
৩০-৩৫% রোগিণী ৫০ বছর বয়েসের আগেই স্তনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন । ম্যাক্স সুপার
স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের,
সিনিয়র কন্সাল্ট্যান্ট অফ সার্জিকাল অঙ্কোলজি-র ডাক্তার ডঃ বিবেক গুপ্তা জানিয়েছেন, ২০১৫ সালের
মধ্যে ভারতে স্তন ক্যান্সারের নতুন রোগিণীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১,৫৫,০০০ জন এবং তাদের মধ্যে ৭৬০০০জন মহিলারই এতে
মৃত্যু হবে । ডাক্তার রুদ্র আচার্যের মতে ভারতে স্তন ক্যান্সারে ব্যাপক মৃত্যুর
একমাত্র কারণ হল, রোগ নির্ণয়ে অহেতুক দেরী ।
ভারতের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে ক্যান্সার রোগটির
সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অনেক ভয়, কুসংস্কার প্রচুর
রোগিণীর মৃত্যুর কারণ । প্রথমত বলে রাখা ভাল, যেকোনো
ক্যান্সারের মত স্তন ক্যান্সারেও সেরে ওঠার জন্য, প্রাথমিক
স্তরে রোগনির্ণয় খুব জরুরী । আমাদের দেশে মহিলাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রোগ
নির্ণয়ের পক্ষে সবচেয়ে বড় বাধা ।
যেকোনো রোগের মতোই এক্ষেত্রেও
"প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর"-এই বেদবাক্যটি মেনে চললে,
জীবনের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব । তাই প্রতি মাসে, একবার
নিজেই স্তন পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরী । স্তনে অস্বাভাবিক কোন ব্যথাযুক্ত, বা ব্যথাবিহীন মাংসপিণ্ড অনুভূত হলে, স্তনের কোন
একটি স্থান লাল হয়ে থাকলে, স্তনগাত্রের ত্বক কমলালেবুর খোসার
মতো ঈষৎ ছিদ্রযুক্ত দেখালে, স্তনবৃন্তটি বসে গেলে (ইনভার্টেড
নিপল) অথবা বৃন্ত থেকে কোন রস গড়ালে, যথা শীঘ্র সম্ভব কোন
স্তনরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন ।
শুনতে সোনার পাথরবাটি মনে হলেও,
স্তনের ক্যান্সার পুরুষেরও হয় । এবং সেক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি যে কোন
মহিলার তুলনায় বেশি।
রোগ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসক,
ইউ এস জি, সিটি স্ক্যান, ম্যামোগ্রাম বা 'ফাইন নিডল অ্যাস্পিরেশন' বা 'এফ এন এ সি' করাতে পরামর্শ
দিতে পারেন । অযথা ভয় পাবেন না । উপরের লক্ষণগুলোর যে কোন একটি দেখা দিয়েছে,মানেই যে ক্যান্সার হয়েছে, তা নাও হতে পারে । আবার,
একথাও ভাবা ঠিক নয়, যে সূঁচ ফুটিয়ে পরীক্ষা
করলেই ক্যান্সার হয়ে যাবে বা দ্রুত রোগ ছড়িয়ে পড়বে ।
রোগ নির্ণীত হলে,
অযথা সাউথে বা মুম্বাইতেই ছুটতে হবে, এ ধারণাও
ভিত্তিহীন । আপনার নিকটবর্তী সরকারী হাসপাতালটিতেও চিকিৎসা করানো যেতে পারে ।
এবার আসি, চিকিৎসার ধাপগুলিতে । প্রথমেই
একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ বা অঙ্কোলজিস্টের পরামর্শ নিন । তিনি কিছু পরীক্ষা
নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেবেন চিকিৎসা কোন পথে এগোবে । যদি, চিকিৎসক
মনে করেন, আগে স্তনের অপারেশন করিয়ে, তারপর
কেমোথেরাপি চালু করবেন । এই পদ্ধতিকে বলে, অ্যাডজুভ্যান্ট
কেমোথেরাপি । আবার, আগে কয়েকটি কেমোথেরাপি দিয়ে, মাংসপিন্ডটি ছোট করে নিয়ে যদি অপারেশন করা হয়, সেই
পদ্ধতিকে বলা হয় নন অ্যাডজুভ্যান্ট কেমোথেরাপি । অপারেশনটি দুভাবে হতে পারে ।
রোগগ্রস্ত মাংসপিণ্ডটি ও তৎসংলগ্ন কিছু টিস্যু কেটে বাদ দিলে, সেটিকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে, 'লাম্পেক্টমি'
। আর পুরো স্তন,
বক্ষপেশির কিছু অংশ এবং বগলের গ্রন্থি বা লিম্ফ নোডস গুলি যদি বাদ
যায়, তাকে বলে 'মাস্টেক্টমি' । এবার বলি,
প্রতিটি রোগিণীর রোগের চরিত্র আলাদা, শারীরিক
অবস্থা আলাদা ।এসব কিছুর উপর ভিত্তি করেই চিকিৎসক ঠিক করেন কিভাবে চিকিৎসা এগোবে ।
স্তনের ক্যান্সার কিন্তু একটি রোগ
নয় । প্রাথমিকভাবে কোন জায়গায় হয়েছে, তার
উপর ভিত্তি করে স্তন ক্যান্সার দুইপ্রকার-লোবুলার কার্সিনোমা, ও ডাক্টাল কার্সিনোমা । চরিত্রগত ভাবে আবার স্তন ক্যান্সারের তিনটি টাইপ ।
তাদের আবার বেশ কতগুলি সাবটাইপ আছে । মোটের উপর টাইপগুলি হচ্ছে,
১.হরমোন পজিটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সার
২.হার টু(2)
পজিটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সার
৩.ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট
ক্যান্সার
প্রতিটি টাইপের চিকিৎসা আলাদা ।
তাই পরিচিত অমুকের তো এই ওষুধ দিয়ে সেরে গেছে সুতরাং আমাকেও এই ওষুধ দিন । এইধরনের
ব্যাপারগুলো সম্পূর্ণ যুক্তিহীন । রুগীর শরীর, রোগের
ব্যাপ্তির উপর নির্ভর করে, কেমোথেরাপি কতদিন পরপর দেওয়া হবে,
ডাক্তার তা ঠিক করেন । কেমোথেরাপি চলা কালীন কিছু বাড়তি সতর্কতা
আবশ্যক । এসময় দ্রুত বেড়ে ওঠা ক্যান্সার কোষগুলো যেমন মারা যায়, তেমনি রক্তকোষ ও দেহের অন্য সুস্থ কোষগুলিও মারা যায় । মাথার চুল ও দেহের
সব রোম উঠে যায় । শ্বেত রক্তকোষ মারা যাবার ফলে, রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় । তাই,কেমোথেরাপি চলাকালীন
রুগীকে অত্যন্ত সাবধানে রাখতে হবে ।
শুধু কেমোথেরাপি, অপারেশন মানেই চিকিৎসা শেষ নয় । অনেক ক্ষেত্রেই রেডিয়েশন থেরাপিও দরকার হয়
। এরপর রোগের টাইপ, সাবটাইপের উপর ভিত্তি করে বেশ কয়েক বছর
টানা ওষুধ খেতে হতে পারে । এই ওষুধপত্র কে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে 'টার্গেটেড থেরাপি'।অর্থাৎ ঠিক যে কারণে স্তন ক্যান্সারটির উৎপত্তি,
সেই কারণটিকেই ওষুধ দ্বারা নষ্ট করে দেওয়া । বর্তমানে 'হরমোন পজিটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সার' এবং 'হার টু পজিটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সার'এর টার্গেটেড
থেরাপি থাকলেও 'ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সার'এর টার্গেটেড থেরাপি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি । তবে,প্রচুর
সম্ভাবনাময় ওষুধের ট্রায়াল চলছে ।
স্তনের ক্যান্সার সাধারণত অনেক
সময়েই আরেকটি স্তনে,
যকৃত, ফুসফুস, মস্তিষ্ক,
ও হাড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে । রোগের এই ব্যাপ্তি সাধারণত রোগের শেষ
পর্যায় । একে মেটাস্টাসিস বলে ।
চিকিৎসা পরবর্তী জীবনে সবথেকে
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, নিয়মিত চিকিৎসকের
পরামর্শে থাকা, ফলো আপ করানো । কারণ, প্রাথমিকভাবে
রোগ সেরে গেলেও ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রবল থাকে, বিশেষত
রোগনির্ণয়ের প্রথম দুটি বছর । (রোগ ফিরে এলে,অর্থাৎ
রেকারেন্স বা মেটাস্টাসিস হলেও চিকিৎসা সম্ভব।) আর দরকার, সংযমী
জীবনযাপন । ধূমপান বর্জন দরকার । নিয়মিত আঁশযুক্ত (ফাইবার সমৃদ্ধ) খাবার, প্রচুর পরিমাণে রঙিন ফল ও শাক সবজি খেতে হবে, অন্তত
পাঁচদিন সপ্তাহে তিরিশ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে ।
পরিশেষে বলি,
স্তন ক্যান্সার মানেই মৃত্যু নয় । প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ ধরা পড়লে
বহুদিন সুস্থ থাকা যায় । আমাদের চারপাশে, বহু নামকরা মানুষ,
বহু অচেনা অজানা মানুষ কিন্তু রোগটি কে জয় করে সুস্থ জীবনযাপন করছেন
। স্তন ক্যান্সার জয় করা সম্ভব । শুধু দরকার দ্রুত রোগনির্ণয় ও কু-সংস্কারমুক্ত সঠিক
চিকিৎসা । আসুন বাঁচি ।
হাতে
হাত ধরে অন্যকে বাঁচাই ।
(পরিসংখ্যান তথ্যসূত্র সৌজন্য:'টাইমস অফ ইন্ডিয়া')
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন